-
Notifications
You must be signed in to change notification settings - Fork 0
/
Copy pathlovestory.json
43 lines (42 loc) · 142 KB
/
lovestory.json
1
2
3
4
5
6
7
8
9
10
11
12
13
14
15
16
17
18
19
20
21
22
23
24
25
26
27
28
29
30
31
32
33
34
35
36
37
38
39
40
41
42
43
[
{
"name": "স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার অপেক্ষা",
"description": "আগামীকাল থেকে অবন্তীর ফাইনাল এক্সাম। মন না চাইলেও রাত ২টায়ও তাকে দেখা যাচ্ছে গভীর মনোযোগে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে থাকতে।\nমাঝরাতে হঠাৎ মুঠোফোনের শব্দে বই থেকে মুখ তোলে অবন্তী। ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখতেই একটি অপরিচিত নম্বর চোখে পড়ে।\n—এত রাতে কে ফোন দিল...\nনিশ্চিত, ক্লাসের কেউই হবে...\nএটা ভেবেই ফোনটি রিসিভ করে অবন্তী।\n‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে একটি মোটা গলা ভেসে আসে...\n—হ্যালো...\nঅবন্তীর কাছে গলার স্বরটি অপরিচিত মনে হয়...\n—কে বলছেন?\n—আমি তমাল...\n—ওহ, তমাল মামা! এত রাতে কী মনে করে?\nগম্ভীর গলায় জবাব,\n—মামা! আমি তমাল; কিন্তু আপনার মামা নই। আমি আরেকজন তমাল, আমাকে চিনবেন না।\n—কাকে চান?\n—এত সময় যখন আপনার সঙ্গে কথা বলছি, ধরে নিন আপনাকেই চাইছি।\n—স্টুপিড!\nবলেই ফোন কেটে দিল অবন্তী। মনোযোগী হয়ে পড়া শুরু করল। কিন্তু কী আশ্চর্য! বারবার কেন যেন ওই কণ্ঠটাই কানে বাজছে!\nইস্! কী অসম্ভব সুন্দর কণ্ঠ লোকটির। অনেকটা আরজে নীরবের মতো।\nকথাগুলো ভাবতেই হঠাৎ আবার মুঠোফোনটি বেজে ওঠে। অবন্তী এবার ঠিক করল, কলটি আর রিসিভ করবে না। কিন্তু কী অদ্ভুত, এত রাতে নির্লজ্জের মতো লোকটা কেন যে বারবার কল করেই যাচ্ছে!\nমুঠোফোনটি বেজেই চলেছে...মিশ্র প্রতিক্রিয়া অবন্তীর। শেষ পর্যন্ত কলটি রিসিভ করল...\n‘হ্যালো’ বলতেই...\n—কী ব্যাপার, রেখে দিলেন কেন?\n—এত রাতে অচেনা একজন মেয়েকে বিরক্ত করতে লজ্জা করছে না আপনার! অসভ্য একটা লোক আপনি।\n—প্লিজ! দয়া করে এভাবে বলবেন না। আমি বাজে ছেলে নই। এটুকু বিশ্বাস রাখতেই পারেন। আপনি আমার পরিচয়টুকু দেওয়ার সুযোগ দিন...\nআমি তমাল। বুয়েটে সিভিলে পড়ছি, তিতুমীর হলে থাকি। সামনে টার্ম ফাইনাল প্রিপারেটি লিভের গ্যাপে আছি। রাত জেগে পড়তে পড়তে হঠাৎ এক বন্ধুকে কল দেব ভেবে ডিজিট ভুলে কলটি আপনার নম্বরে চলে যায়। আমার কী দোষ বলুন, আপনার কণ্ঠে জাদু আছে। যে কেউ আপনার সঙ্গে কথা বললে অবচেতন মনে চাইবে আরেকবার কথা শুনতে!\n—দেখুন, কাল আমার ফিজিওলজির কার্ড এক্সাম। এমনিতেই আমি খুব টেনসড। দয়া করে আর বিরক্ত করবেন না। আপনাদের মতো ছেলেরা মেয়েদের ইমপ্রেস করায় খুব পটু।\nকথাগুলো বলেই কলটি কাটল অবন্তী। ফোনটি রাখার কিছু সময় পর মুঠোফোনের মেসেজ রিংটোন বেজে উঠল...\n‘ফিজিওলজির কার্ড এক্সাম! তার মানে মেডিক্যাল স্টুডেন্ট! ডাক্তারদের মেজাজ এত রুড হলে চলবে? আবার বিরক্ত না করে পারব না হয়তো। এতটা বকাঝকা আগামী দিন আর করবেন না আশা রাখব। শুভ রাত্রি।’\nকী রকম যেন এক অদৃশ্য ভালোলাগার শিহরণের মধ্য দিয়ে সময় কেটে যায় অবন্তীর। অবচেতন মন কেন যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ফোনের জন্য! খাবার টেবিল থেকে পড়ার টেবিল—সারাটা সময় মুঠোফোনটি ওর সঙ্গেই আছে। বাড়ির কারোরই ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায় না। এমনিভাবে এক সপ্তাহ শেষে একদিন রাত প্রায় সাড়ে ১২টায় সেই প্রতীক্ষিত নম্বরটি ফোন স্ক্রিনে ভেসে ওঠে।\nঅবন্তী ফোন রিসিভ করতেই সম্ভাষণের বদলে চমত্কার ভরাট কণ্ঠের আবৃত্তি শোনা যায়...\n‘পাইনি বলে আজও তোমায় বাসছি ভালো রানি...\nমধ্যসাগর এপার-ওপার করছে কানাকানি...’\nফোনের ওপাশ থেকে ভদ্রলোকের কবিতা পড়া শুনে অবন্তী যেন ভালোলাগার বিস্ময়ে ভাষা হারিয়ে ফেলে!\n—কী ব্যাপার, কথা বলবেন না? কেমন লাগল কবিতাটা? আজ কিন্তু হঠাৎ করে ফোন কাটা যাবে না!\n—অসাধারণ! খুব ভালো কবিতা আবৃত্তি করেন তো আপনি!\n—সত্যি, আপনার ভালো লেগেছে? ধন্য আমি! আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম, এই বুঝি অভদ্র-অসভ্য বলে কল কেটে দেবেন!\nএর পর থেকে শুরু ওদের একসঙ্গে পথচলা। সময় গড়িয়ে সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা পেরিয়ে সপ্তাহ থেকে মাস ছুঁয়ে যায়...\nসকাল-বিকেল কিংবা মাঝরাতে ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে চ্যাটিং ঘণ্টার পর ঘণ্টা...ভালোলাগার অনুভূতিটা কখন যেন ভালোবাসা হয়ে মন জুড়ে বসে...\nদেখতে দেখতে সময় কেটে যায়...কাছে আসার আকুল তৃষ্ণায় মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে...দীর্ঘ এক বছর পর তমাল আর অবন্তী পহেলা ফাল্গুনের এক বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরিতে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়...\nপাবলিক লাইব্রেরির রাস্তা দিয়ে ভেতরে প্রবেশের সময় এদিক-সেদিক তাকিয়ে মনের অজান্তেই কাউকে খুঁজে যায় অবন্তী। ঠোঁটের কোণে তখনো একচিলতে হাসি...\nহঠাৎ মুঠোফোনে মেসেজ রিংটোন বাজতেই অবন্তী চোখ রাখে স্ক্রিনে। ছোট্ট একটা মেসেজ,\n‘আসছি অবন্তী, শাহবাগে আমি...।’\nহাঁটতে হাঁটতেই রিপ্লাই করে অবন্তী...\n‘স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছি’...\nপাবলিক লাইব্রেরিতে প্রবেশ করে কিছুটা দূর থেকেই তমাল দেখে, অবন্তী সিঁড়ির একপাশে চুপচাপ বসে আছে। মেয়েটি...মেয়েটি আসলেই সুন্দরী...হলুদ রঙের শাড়িতে ওকে একটু বেশিই মানিয়েছে।\nঅবন্তী তমালকে বলেছিল কালো রঙের পাঞ্জাবি পরতে অথচ ও পরে এসেছে সাদা রঙের ক্যাজুয়াল শার্ট।\nসিঁড়ি বেয়ে অবন্তীকে পাশ কাটিয়ে একটু দ্রুতই পাবলিক লাইব্রেরির ভেতর চলে যায় তমাল। এর একটু পরই অবন্তীর পেছনে এসে দাঁড়ায়...\nহঠাৎ করেই ডেকে ওঠে অবন্তী বলে...\nঅবন্তী পেছন ফিরে তাকাতেই ভীষণ চমকে ওঠে! একি, তমালের পাশে রূপক কেন!\nএই ছেলেটা অবন্তীর ক্লাসমেট। দীর্ঘ দুই বছর ধরে ওকে বিরক্ত করে যাচ্ছে...একে দেখলেই অবন্তীর ভীষণ রাগ হয়।\nঅবন্তী কোনো প্রশ্ন করার আগেই তমাল বলে ওঠে, ‘রূপক আমার ছোট ভাই। ওর ধারণা ছিল, তুমি নাকি ভালোবাসতেই জানো না। ওর সঙ্গে আমি চ্যালেঞ্জ করেছিলাম, তোমাকে ভালোবাসতে শেখাব আমি। তোমার সঙ্গে সম্পর্কের শুরুটাই ছিল একটা জেদ। তোমাকে আমি শুধু বোঝাতে চেয়েছিলাম, ভালোবাসার অনুভূতিটা কেমন হয়...ভালোবাসা আসলে কী...’\nদীর্ঘ সময় নির্বাক হয়ে তমালের কথাগুলো শোনে অবন্তী। চোখ দুটি কখন যেন নিজের অজান্তেই অশ্রুসজল হয়ে ওঠে...\nতমালের কথার প্রত্যুত্তরে অবন্তী শুধু একটি কথাই বলে...‘তমাল, আপনি আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন? আমার কল্পনায় যে ভালোবাসা ছিল তা আসলে ভালোবাসা নয়, শুধুই প্রতারণা। ভালোবাসা কী, তা হয়তো আর এ জন্মে বোঝা হলো না...’\nকথাগুলো শেষ করেই অবন্তী হাঁটতে শুরু করে, পাবলিক লাইব্রেরির গেট থেকে বেরিয়ে দ্রুত রিকশা নেয়। রিকশা চলতে শুরু করে সন্ধ্যার আবছা আলো-আঁধারি পথ ধরে। রিকশা এগিয়ে যায় সামনে...\nপেছনে পড়ে থাকে অনেক কল্পনায় আঁকা কিছু স্বপ্ন...\nস্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় এত দিনের রঙিন স্বপ্নে বিভোর দুটি চোখ বেয়ে অপমানের, দুঃখের আর হতাশার জল গড়িয়ে পড়ে। তবু মন মানে না। নিজের মনকে বিশ্বাস করতে পারে না।\nশাহবাগ পেরিয়ে রিকশা বাংলা একাডেমির সামনে যেতেই একটি মোটরবাইক অবন্তীর রিকশার সামনে এসে থামল...\nচমকে উঠল অবন্তী। বাইক থেকে নেমে তমাল রিকশার সামনে দাঁড়াল...\n‘আপনি আমার পিছু নিয়েছেন কেন? ভালোবাসা কী, তা শেখাতে চেয়েছিলেন! আমি তো ভালোবাসতে শিখে গেছি...’\nকথাগুলো বলতে গিয়ে রাগে-অপমানে কেঁদে ফেলল অবন্তী।\nতমাল হাত জোড় করে ওর রিকশার সামনে দাঁড়াল...‘ক্ষমা করে দাও অবন্তী...আমিও যে ভালোবাসতে শিখে গেছি তোমার পাশে থেকে...তোমার অভিমানী চোখ বলে দিয়েছে, আমি কতটা অপরাধী...নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়... তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না...প্লিজ! ফিরিয়ে দিয়ো না।’\n \nলেখকঃ কথা ঘোষ\nতৃতীয় বর্ষ, বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ",
"img": "https://raw.githubusercontent.com/RIHeera/LoveStory/master/sopnoke-chhuye-dekhar-opekkha.jpg"
},
{
"name": "ছয় তারের ভালোবাসা",
"description": "সে ছিল এডগার এলেন পোর মানস প্রেয়সী এনাবেল লির অন্ধভক্ত, আর আমি ছিলাম বনলতা সেনের শাশ্বত প্রেমিক। সে ছিল ৩.৮ সিজিপিএ-ওয়ালা ক্লাস টপারদের একজন, আমার সিজিপিএ কেউ জিজ্ঞেস করলেই একগাল হেসে বলতাম, কেন লজ্জা দিচ্ছেন ভাই? সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কন্যাটি যখন প্রাইভেট কার থেকে নেমে ক্লাসে প্রবেশ করত, পুরো ক্লাস যেন ঝলমল করে উঠত! আর আমি যখন ক্লাসে ঢুকতাম, জানালায় বসা দাঁড়কাকটা ভাবত, ‘ছোকরার এলোমেলো চুলে একবার বাসা বাঁধতে পারলে শীতকালটা বেশ আরামে কেটে যেত!’ তার জন্মের সময় ঢাকা শহরে তুষারপাত হচ্ছিল কি না জানা নেই, তবে আমার জন্মের সময় খুবসম্ভব কারেন্ট চলে গিয়েছিল— নতুবা এই গায়ের রং হয় কী করে!\nএত বৈপরীত্যের মধ্যেও সেই অলিম্পাসের চূড়া থেকে কিভাবে ওর নাম লেখা কিউপিডের ছোড়া তীর নির্ভুলভাবে আমাকেই বিদ্ধ করে, সে প্রশ্নের জবাব মনে হয় না স্বয়ং সিগমুন্ড ফ্রয়েডও দিতে পারতেন!\nউঁহু, বাবা! প্রকৃতি কোনো অসামঞ্জস্য সহ্য করে না। সে বড় নির্দয় বিচারক! কয় দিনই বা ক্লাস শেষে ওর পিছু পিছু ছবির হাটে লুকিয়ে-চুরিয়ে ঘুরেছি? বড়জোর মাস দেড়েক! এরই মধ্যে হঠাৎ করে একদিন পেছন দিক থেকে এসে আমার কলার চেপে ধরল :\n‘আমার পিছু নিস ক্যান প্রতিদিন, ক্লাস শেষ হলে?’\nবিকেলের নরম রোদ বড় আয়েস করে এলিয়ে পড়েছিল ওর গালে, মুখে, ঠোঁটে!\nএকেই কি বলে শ্রাবস্তীর কারুকার্য?\n‘প্রতিদিন না, আজই এলাম, তা-ও তোমার পিছু পিছু না’, আমি কাঁচুমাচু মুখে মিথ্যের ডালি সাজাই—‘শুনেছি, আজ এখানে সুররিয়ালিস্টিক পেইন্টিং এক্সিবিশন হবে!’\n‘ছবির হাটে আজ সুররিয়ালিস্টিক পেইন্টিং এক্সিবিশন’, ওর ভ্রু কুঁচকে যায়—‘জানতাম না তো?’\nহঠাৎ আমার দিকে কটমটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে—\n‘বল, দু-একজন সুররিয়ালিস্টিক পেইন্টারের নাম বল।’\nআমার ভ্যাবাচেকা খাওয়া মুখ দেখে ও খুশি হয়ে যায়। আমি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অবলীলায় বলে দিই,\n‘আর্নস্ত চে গুয়েভারা! ওই যে একটা ছবি আছে না—মাথায় বিপ্লবীর টুপি আর একমুখভর্তি দাড়ি নিয়ে দূরে কোথাও বিষণ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এক লোক, সেটাই তার আঁকা সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি!’\nআমি অধীর চিত্তে অপেক্ষা করি কিছুক্ষণ। শ্রাবণের প্রথম বাদলধারার মতো ওর মুখচ্ছবি হাসিতে উদ্বেল হয়ে ওঠে মুহূর্তের জন্য। ওর এই হাসি দেখার জন্য আমি আজীবন কেবলাকান্ত সেজে থাকতে রাজি আছি—ও কি তা জানে?\nহঠাৎ থেমে গিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আমাকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করে সবার সামনে! আমি তার কিছু শুনি, কিছু শুনি না। যা বলে তার খুব অল্পই বুঝি, বেশির ভাগই বুঝি না। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি, ও হেঁটে চলে যায়, একবারের জন্যও ফিরে তাকায় না।\nনাকি তাকায়? কে জানে!\nতারপর আমার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ শীতকালটি আসে। আমি ক্যাম্পাস বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিই। আলমারির কোণ থেকে টেনে বের করি ধুলাজর্জরিত গিভসন গিটারখানা। টুংটাং সুর তুলি তাতে—কিছু কর্ড সার্কেল, কমল ভাইয়ের গিটার ক্লাসে শেখা পুরনো কিছু লেসন প্র্যাকটিস করি। সর্বোপরি চেষ্টা করি ওকে মন থেকে শিফট চাপ দিয়ে ডিলিট বাটন প্রেস করার মতো পার্মানেন্টলি ডিলিট করতে।\nপারি আর কই!\nআমার লিরিক লেখার খাতায় জমে ওঠে একটি, দুটি করে নতুন কিছু গান। তাতে সুর বসাই।\nকিছুটা বন্ধুদের আহ্বানে আর অনেকটাই প্রাণের টানে ফিরে আসি আবার ক্যাম্পাসে। এবার আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী আমার গিটারখানা।\nবন্ধুদের নতুন কম্পোজ করা গানগুলো শোনাই। টিএসসি, হাকিম চত্বরের চায়ের দোকান ও আশপাশের জায়গা সরগরম হয়ে ওঠে গানের সুরে।\n‘সেই ছেলেবেলা থেকে মনের খাতায় কত শত আঁকিবুঁকি\n স্বপ্ন আমার নাটাই ছেঁড়া ঘুড়ি,\n গায়ক নায়ক কত কিছু হওয়া এক জীবনের খাতায়\n বন্ধু মহলে ভীষণ বাহাদুরি!\n আজ শেষ বিকেলের আলোয় আমার একটাই খালি চাওয়া\n চাইলেই তুমি দিতে পারো সহজেই\n ভার্সিটির প্রতিটি বিকেল তোমার স্মৃতিতে নাওয়া\n দাও একটা বিকেল যাতে তুমি মিশে নেই,\n মিশে নেই......’\nবন্ধুবান্ধবদের গান পছন্দ হয়। অনেকেই শিখে নেয় গানটা। অনেকেই জিজ্ঞেস করে—গানটা কাকে নিয়ে? আমি মৃদু হাসি। ওরা আমার হাসির অর্থ পড়তে পারে না। বিরক্ত হয়, প্রশ্ন করা বন্ধ করে দেয়।\nআমি সচেতনভাবে ওকে এড়িয়ে চলি! ও যে রাস্তা দিয়ে হাঁটে, আমি তার উল্টো রাস্তা ধরি। কখনো-সখনো একদম এড়াতে না পারলে জ্যাকেটের হুডি দিয়ে চেহারা ঢেকে ফেলি।\nএক সকালে ডিপার্টমেন্টের করিডরে এসে দেখি, দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ও। ওর বিপরীতে, দোতলার বাউন্ডারিতে আমারই গিটার হাতে বসা আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু অতনু। ডিপার্টমেন্টের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে আসছে আমার খুব চেনা একটা সুর, প্রিয় কিছু শব্দ—\nআজ শেষ বিকেলের আলোয় আমার একটাই খালি চাওয়া\n চাইলেই তুমি দিতে পারো সহজেই\n ভার্সিটির প্রতিটি বিকেল তোমার স্মৃতিতে নাওয়া\n দাও একটা বিকেল যাতে তুমি মিশে নেই...\nআমি আমার হারানো প্রেমের চোখে এমন দুর্লভ মায়াবী একটা চাহুনি দেখলাম অতনুর প্রতি, যা একটিবার, সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্যও যদি আমার জন্য হতো, আমি ধন্য হতাম!\nবিকেলে টিএসসিতে অতনু গিটারটা ফেরত দিতে এলে আমি হাসিমুখে তা ফেরত নিই। ও চলে গেলে সবার সামনে গিটারটা শক্ত পাথুরে মেঝেতে আছড়ে ভাঙি। আমার সুর আমার পিঠে ছুরি বসিয়েছে। আমার আর গান লেখার শখ নেই!\nদিনকয়েক পরের ঘটনা। শীত প্রায় শেষ, বসন্ত হয় হয়। মধ্যে আবার ক্যাম্পাসে যাইনি প্রায় এক সপ্তাহ। হঠাৎ একদিন সাতসকালে কলিংবেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙে। আমি আবার লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর পাঁয়তারা করছি, এমন সময় আম্মুর ডাকে বিছানা ছেড়ে উঠতে হয়। এই ভোরবেলা কে নাকি দেখা করতে এসেছে আমার সঙ্গে!\nড্রয়িংরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আমি একদম জমে যাই পুরোপুরি!\n‘কী রে ক্যাবলা, রাগ করেছিস আমার ওপর?’\nআমার হতভম্ব অবস্থা দেখে ও-ই প্রথম মুখ খোলে। ওর হাতে সুন্দর করে র্যাপিংপেপারে মোড়ানো ওটা কী? দেখে তো গিটার মনে হচ্ছে!\nও আমার ইঞ্চিখানেক দূরত্বে এসে দাঁড়ায়। মধ্যে থাকে কেবল একটা গিটার, র্যাপিংপেপারে মোড়া সুদৃশ্য সেই গিটার!\n‘আমাকে নিয়ে গান লিখিস লুকিয়ে লুকিয়ে, আমাকে বলিসনি কেন?’ ও যুদ্ধাংদেহী ভাব ধারণ করে! আমি কাঁচুমাচু করি। ও আরো কাছে সরে আসে, আমি সন্ত্রস্ত হই—\n‘আম্মু আছে বাসায়!’\n‘তাই না? আমাকে নিয়ে যখন গান লিখিস, তখন তোর মা এসে পিটুনি দেয় না?’ ও আমার পিঠে মৃদু কিল দেয়।\n‘একটুতেই এত রাগ? অতনু না হয় একবার গানই শুনিয়েছে আমাকে, তাই বলে নিজের গিটার ভেঙে ফেলেছিস।’ ও আবার মেকি রাগের ভাব দেখায়—‘কত পয়সা খসালি আমার দেখ!’\nআমার হাতে গিটার তুলে দিয়ে ও একটু দূরে দাঁড়ায়—\n‘চে গুয়েভারা, অ্যাঁ? তা বিপ্লবী, অস্ত্রের বদলে গিটার কেন তোমার হাতে?’\n‘যে যুদ্ধের যা অস্ত্র’, মৃদু হেসে বলি আমি!\n সেদিন প্রথমবারের মতো এনাবেল লির হাত বনলতা সেনের প্রেমিকের হাতে মুঠোবন্দি হয়। চোখে চোখে বলা হয়ে যায় মাসখানেকে জমানো অনেক না-বলা কথা।\nবন্ধু মহল এখনো আমাকে জিজ্ঞেস করে, সেদিন এনাবেল লির অধরে বনলতা সেনের প্রেমিকের অধর মিলেছিল কি না। আমি মুচকি হেসে বলি—সে গবেষণা জাতির বিবেকই করুক!\n \nলেখকঃ সাজিদ উল হক আবির\nইংরেজি বিভাগ\nঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়",
"img": "https://raw.githubusercontent.com/RIHeera/LoveStory/master/chhoy-tarer-valobasa.jpg"
},
{
"name": "দ্বিধা",
"description": "‘ম্যাম, মেন্যুটা কি নিয়ে যাব?’ এশা চোখ গরম করে ওয়েটারের দিকে তাকাল।\n‘নিয়ে যান।’ এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো ওয়েটার মেন্যু ফেরত চাইতে এসেছে। ছুটির দিনের মধ্যদুপুর। রেস্টুরেন্ট খাঁ খাঁ করছে। ইউনিভার্সিটি এলাকার রেস্টুরেন্টগুলো ছুটির দিন খালি থাকে। এশা আজকে এসেছে অয়নের সঙ্গে দেখা করতে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে, ইউনিভার্সিটি খোলা থাকুক আর বন্ধ থাকুক, এই চায়নিজ রেস্টুরেন্টেই সে আসবে। ওয়েটারগুলো সব পরিচিত। অথচ তাদের আচরণ অদ্ভুত। কখনো বিনয়ে থুঁতনি বুকের সঙ্গে লাগিয়ে রাখে, কখনো বারবার টেবিলের চারপাশে ঘুরে বিরক্ত করে। এখন বিরক্ত করছে ভেবেই এশার মন খারাপ হলো। আজকে তার প্রাইভেসি দরকার। এশা অস্থির হয়ে হাতঘড়ি দেখল। ২৫ মিনিট লেট। দেরি করার ছেলে অয়ন না। আজকেই কেন সে দেরি করবে? আজকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন যে সাময়িকভাবে এশার ক্ষুধা-তৃষ্ণা চলে গেছে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে অয়নের সঙ্গে তার ভয়াবহ ঝগড়া চলছে। আজকে শেষ দিন। এশা ঠিক করেছে, আজকের পর থেকে এটা নিয়ে কোনো কথা বাড়াবে না। হয় অয়ন তার সিদ্ধান্ত মেনে নেবে, না হলে আলাদা হয়ে যাবে। কোনো মধ্যম পন্থা নেই। অন্যমনস্ক হয়ে এশা টিভির দিকে তাকিয়ে চিন্তা করছিল। টিভি সাইলেন্ট করে রাখা। শব্দহীন অ্যাডে মানুষের হাত-পা ছুড়ে নাচানাচি হাস্যকর লাগে। দরজা খোলার শব্দে সে ঘুরে তাকাল। অয়ন বিরক্ত মুখে ঢুকছে। কড়া রোদে মুখ লাল হয়ে আছে। টকটকে লাল একটা টি-শার্ট পরে আছে। তাকে দেখাচ্ছে পাকা টমেটোর মতো। এশা হাত নেড়ে ডাকল। সে গম্ভীর মুখ করে আসছে। এশার কেন জানি খুব অদ্ভুত লাগছে। গত তিন বছরে সে অনেকবার অয়নকে এভাবে আসতে দেখেছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, এই শেষ দেখা। অজান্তেই সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অয়নের সঙ্গে এশার পরিচয় চার বছর আগে। নভেম্বরের মাঝামাঝি যমুনা ফিউচার পার্কে একটা Comicon হয়েছিল। এশা সেখানে ‘Game of Thrones’-এর নায়িকা ডিনারিস টারগেরিয়ান সেজে কসপ্লে করেছে। প্রগ্রামের দিন সে যখন হেঁটে যমুনা ফিউচার পার্কে ঢুকছে তখন হঠাৎ কথাবার্তা ছাড়া ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হলো। ফিউচার পার্কের এক নম্বর গেটে ঢোকার রাস্তায় অনেকক্ষণ হাঁটতে হয়। কোনো ছাউনিও নেই, যেখানে অপেক্ষা করা যায়। ডিনারিসের লম্বা ব্লন্ড চুলের কোনো উইগ না পেয়ে এশা একটা কালো উইগ পুরোটা সাদা রং করে পরেছিল। নরমাল water colour, বৃষ্টির পানিতে পুরো ধুয়ে যাবে। এশা বুঝতে পারছিল, ফিউচার পার্কের গেটে যাওয়ার পর তাকে দেখাবে কালো চুলের বাঙালি খালিসি, সারা গায়ে ভূতের মতো সাদা রং। সবাই হা হা করে হাসবে। এমন অসহায় মুহূর্তে হঠাৎ পেছন থেকে ছাতা ধরে অয়ন হাজির হলো। ‘আপু, ছাতা নিয়ে ঠিকভাবে দাঁড়ান, আপনার চুলের ওপরের অংশ অলরেডি অ্যাশ হয়ে গেছে।’ সে এশাকে গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে উধাও হয়ে গেল, ঠিক করে থ্যাংকসও দেওয়া হলো না। এর এক মাস পর এশা তাকে একটা রেস্টুরেন্টে দেখল। ফ্রেন্ডদের সঙ্গে বসে ছবি তুলছে। এশাকে প্রথমে সে চিনতে পারেনি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল, ‘ওহ্, খালিসি। আরে, তোমাকে তো কালো চুলে আরো pretty লাগে!’ অয়ন কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে আছে। ওয়েটারের খোঁজে একটু পর পর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। এশার মনে হলো, সে তৃষ্ণার্ত। সে ব্যাগ খুলে পানির বোতল এগিয়ে দিল।\nতিন বছর দীর্ঘ সময়। সপ্তাহে চার দিন করে হিসাব করলে ৫৭৬ বার অয়ন এভাবে তার সামনে এসে বসেছে। অথচ আজকে এশার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে; যদিও অয়ন কিছু বলেনি। কিন্তু সে জানে, এ বসাই শেষ বসা। আর কোনো দিন রাজপুত্রের মতো রূপবান এ তরুণের সামনে সে সেজেগুজে বসে থাকবে না। আহ্লাদ করে বলবে না, ‘অ্যাই, আমার দিকে তাকাও না কেন?’ চুলে হাত বুলিয়ে না দিলে আর অভিমান করবে না। অনেক ভালোবাসার কথা, যা এখনো জমা আছে, আর বলা হবে না।\nঅয়ন বলল, ‘শুরু করব?’ এশা সোজাসুজি তার চোখের দিকে তাকাল, ‘তুমি জানো, আজকে তোমার শেষ সুযোগ। বারবার ফালতু কথা বলে সময় নষ্ট করবে না, বলো, and make it short and exactly to the point.’ ‘ঠিক আছে, আমার main problem হলো career. যদি এখনই বিয়ে করে ফেলি, তাহলে পড়ালেখায় অনেক ক্ষতি হবে।’ এশা জানত, সে এভাবেই শুরু করবে। সে অয়নকে মাঝপথে থামিয়ে দিল।\n‘অয়ন, আমি জানতাম তুমি আবার একই প্যাঁচাল পাড়বে। আমি ত্বধফু হয়ে এসেছি। I have a letter for you, চুপচাপ এটা পড়ো, story খতম।’ অয়ন বিরক্ত মুখে চিঠিটা নিল। পড়ার কোনো ইচ্ছা আছে বলে মনে হচ্ছে না। “অয়ন, গত তিন বছরে অনেকবার আমি এই চিঠিটা লিখতে চেয়েছি; কিন্তু পারিনি। তিন বছর দীর্ঘ সময়। তবে কাউকে পুরোপুরি জানার জন্য সময়টা খুব বেশি না কিন্তু। অনেকেই বলে, মানুষ চিনতে সময় লাগে না। আমার কিন্তু এটা মনে হয় না। আমার ধারণা, কিছু মানুষকে চেনার জন্য সারা জীবনও যথেষ্ট নয়। তুমি যে সেই দলের, এটা বুঝতে আমার তিন বছর লেগে গেল। আচ্ছা, চিঠিটা আমি গুছিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। একটা একটা করে বলি। প্রথমে বলি আমাদের সমস্যা নিয়ে। আমাদের ঝামেলা শুরু হয়েছে দুই মাস আগে, যখন প্রথমবার আমার বাসা থেকে বিয়ের জন্য প্রেসার দেওয়া শুরু করল। তোমার সঙ্গে গত তিন বছর আমি অ-নে-ক সুখী ছিলাম না এটা সত্যি; কিন্তু তোমাকে বিয়ে করা নিয়ে কোনো দ্বিধা আমার ছিল না। তোমার কোনো সমস্যা থাকবে, এটা কোনো দিন আমি ভাবিনি। কারণ আমার ধারণা ছিল, আমাদের মধ্যে তুমিই বেশি সংসারপাগল। যখন তোমাকে বিয়ের কথা বললাম, অদ্ভুত শ্যেনদৃষ্টিতে তুমি আমাকে দেখলে, সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝে গেলাম, এই ছেলে আমাকে চায় না। বিয়ে নিয়ে কত কোটি অজুহাত তুমি দিয়েছ, তা লিখতে গেলে চিঠি শেষ হবে না। আমি ধৈর্য ধরে তোমার প্রতিটি অজুহাত মেনে নেওয়ার পর তুমি যখন আর কিছুই না পেয়ে সত্যি কথা বলে দিলে, আমি কিন্তু অবাক হইনি। আমি জানতাম, আমার জীবনে তুমি রোবট বয়ফ্রেন্ড, মানবিক আবেগের ঊর্ধ্বে। আমাদের অনেক বড় সমস্যার অতি ক্ষুদ্র অংশ বিয়েসংক্রান্ত ঝামেলা। প্রথম থেকেই তোমার মনে কোনো প্রেম নেই। এটা আমি কখনোই ঠিক করে বুঝতে পারিনি। কারণ যখনই তুমি আমাকে প্রচণ্ড কষ্ট দিয়ে কিছু করেছ, তার পরপরই এমন অদ্ভুত কিছু করতে যে আমি ভুলেই যেতাম একটু আগে আমার সঙ্গে ভয়াবহ অন্যায় হয়েছে। উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। একবার তুমি আমাকে বললে, তোমার বন্ধুর ভাইয়ের বিয়ের দাওয়াতে আমাকে নিয়ে যাবে। এর আগে আমরা কখনো একসঙ্গে এমন formal দাওয়াতে যাইনি। আমি excited হয়ে দুই দিন আগে থেকে শাড়ি গুছিয়ে রাখলাম, এক দিনের মধ্যে নতুন ব্লাউজ বানালাম, অনেক ঝামেলা করে বাসার পারমিশন জোগাড় করলাম। বিয়ের দিন বিকেল থেকে সেজেগুজে বসে আছি। সন্ধ্যা ৬টায় তোমার আমাকে নিতে আসার কথা। রাত ৯টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ক্লান্ত হয়ে আমি শাড়ি খুলে মুখ ধুয়ে ফেললাম। সারা দিন কল দিয়ে তোমার ফোন বন্ধ পেয়েছি। ১০টায় facebook-এ ঢুকে দেখি, বিয়েবাড়িতে বন্ধুদের সঙ্গে তোমার হাস্যোজ্জ্বল ছবি। এই ভয়ংকর অন্যায়ের পর তোমার সঙ্গে আমি যোগাযোগ বন্ধ রেখেছিলাম। এক সপ্তাহ পর একদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল, মনে আছে? আমি মন খারাপ করে বারান্দায় ভিজছিলাম। হঠাৎ সাইকেলে তোমাকে একগাদা ফুল নিয়ে বাসার নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার সব রাগ-অভিমান ধুয়ে গেল। সেটা একটা বেশি সুন্দর দিন ছিল, সারা দিন তোমার সাইকেলের পেছনে বসে ঘুরেছি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে টং দোকানে চা খেয়েছি, রমনা পার্কের বেঞ্চে বসে দীর্ঘ সময় ছোট বাচ্চাদের বৃষ্টিতে ভিজতে দেখেছি। একবারও আমার মনে পড়ল না, ঠিক এক সপ্তাহ আগে এমনই একটা বিকেল কী অনিশ্চয়তায় আমি পার করেছি। তোমার ফোন বন্ধ, বাসার সবাই একটু পর পর এসে জিজ্ঞেস করছে দাওয়াতে যাচ্ছি না কেন। চোখের পানিতে লেপ্টে যাওয়া কাজলের ওপর সাবধানে face powder ঘষেছি। ভালোবাসার বৃষ্টিস্নানে তোমার প্রতি সব দ্বিধা বারবার ধুয়ে-মুছে গেছে। তুমি আমাকে কখনোই ভালোবাসোনি, অয়ন। সত্যি কথা বলতে কি, আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা আর একটা সিগারেটের জন্য তোমার ভালোবাসা একই জিনিস। কাউকে ভালোবাসার জন্য যে হৃদয় প্রয়োজন তা তোমার নেই। আমি মোহাচ্ছন্নের মতো তোমার মায়ায় বাঁধা পড়েছিলাম। নানাভাবে তুমি আমাকে কষ্ট দিয়েছ। যখন আমার বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপাচাপি শুরু করল, তোমার কোনো ধারণাই নেই আমার কতটা অসহায় লেগেছে। কারণ দুই মাস আগেই আমি আজকের এই দিন কল্পনা করেছি। আমি ভালো করেই জানতাম, আমাদের প্রেমের প্রথম চ্যালেঞ্জেই তুমি পেছনের দরজা দিয়ে পালাবে। এ জন্য আমি এখন বিস্মিতও নই যে কোনো solution ছাড়াই তুমি শেষবারের মতো আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ।\nআজকে বাসায় গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাটে স্বাভাবিকভাবে লিখবে, ‘দোস্ত, পুরা ব্র্রেক আপ। প্যারা বন্ধ।’ একদমই যে আমাকে মিস করবে না, তা না। তোমার নতুন প্রেমিকা যখন বারবিকিউ চিকেন বানাতে পারবে না তখন মনে মনে ভাববে, ‘ইস, আগেরটা পারত।’ কিংবা বন্ধুরা গ্রুপ চ্যাটে আমার চেয়ে কম সুন্দর কোনো মেয়েকে নিয়ে মাতামাতি করলে ভাববে, ‘উফ্, এর চেয়ে সুন্দর মেয়ে আমি ডেট করেছি।’ তোমার সব অনুভূতি আমার চেহারা আর রান্নার skill-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাসায় যাওয়ার সময় রিকশায় পেছন ফিরে তোমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকার মর্ম তুমি বুঝবে না। গত তিন বছরে গভীর রাতে পাঠানো অদ্ভুত texts তোমার কাছে ছেলেমানুষিই মনে হবে। তিন বছরের প্রেমিকার সঙ্গে ব্রেক আপ আর তিন মাসের প্রেমিকার সঙ্গে ব্রেক আপ তোমার কাছে একই বস্তু। যন্ত্রের জন্য সবই সমান।\nচিঠি শেষ করে আমার দিকে তাকালে তুমি দেখতে পাবে, আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছি। বিদায়বেলায় আমার কান্নাভেজা চোখ দেখার যোগ্যতাও তোমার নেই। দয়া করে শেষবার আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বিদায় হয়ে যাও। দোয়া করি, অনেক ভালো রেজাল্ট করো সারা জীবন। যে দোহাই দিয়ে আমাকে হাসিমুখে sacrifice করলে, অন্তত সেটা যেন বৃথা না যায়। রোবটমানব, good bye.” এশা কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুলে হাতের স্পর্শ পেল। তারপর পেছনে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনল।\nঅয়ন Floor-6-এ ঢুকে একটু চমকে গেল। এরা decoration বদলে ফেলেছে। আগের চেয়ে অনেক সুন্দর লাগছে এখন। সে ফোনে সময় দেখল। ৪টা বাজে, রুবাবার আসার কথা সাড়ে ৪টায়। টাইমলি কাজ করা অয়নের অভ্যাস। আজকে রুবাবার সঙ্গে দ্বিতীয় দিন দেখা করতে এসেছে। লেট করতে চায় না। কোনার দিকে একটা সোফায় রুবাবাকে বসে থাকতে দেখে অয়ন বিস্মিত হলো। ‘আরে, কখন এসেছ?’ ‘sorry, আগে এসে তোমাকে ভড়কে দিলাম।’ ‘আরে নাহ্। খুশি হয়েছি। কতক্ষণ বসে আছ?’ ‘10 minutes.’ ‘Did you get bored?’ ‘না না, সধমধুরহব পড়েছি এতক্ষণ।’ খুশিতে রুবাবা ঝলমল করছে। নীল জামায় মেয়েটাকে পরির মতো লাগছে। কিন্তু এশার কাছে এই মেয়ে কিছুই না। এশা পরির চেয়েও সুন্দর। এশার চিন্তা মাথায় আসায় অয়ন একটু অস্বস্তিতে পড়ল। রুবাবার দিকে তাকিয়ে হাসল, ‘You look very pretty by the way.’ ‘Thank you, বসো। দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ বসতে বসতে অয়ন লক্ষ করল, মেয়েটা পা নাচাচ্ছে। এশা পা নাচানো খুবই অপছন্দ করত। এখন বোঝা যাচ্ছে কেন। দৃশ্যটার মধ্যে অসুন্দর একটা ব্যাপার আছে। অয়নের দিকে তাকিয়ে রুবাবা বলল, ‘মেন্যু দিতে বলেছি। এখানে তোমার প্রিয় খাবার কী?’ মেয়েটার চোখ বড় বড়। এশার চোখ এর চেয়ে ছোট, কিন্তু অনেক বেশি সুন্দর। এশা যা-ই করে, তার চোখে ছায়া পড়ে। কথাটা কোনো দিন বলা হয়নি। আর কোনো দিন মনে হয় বলাও হবে না। এশাকে সে শেষবার দেখেছে সাত মাস আগে সেই রেস্টুরেন্টে। চিঠিটা এখনো পকেটে নিয়ে ঘুরছে। কেন জানি ফেলতে পারে না। মানিব্যাগে রয়ে গেছে। এশা এখন কেমন আছে? এখন কি রাতে একা ঘুমাতে ভয় পায়? ভয় কাটাতে কাকে ফোন করে? কতক্ষণ এসব ভাবছিল মনে নেই, কাঁধে মৃদু ঝাঁকুনিতে সে সংবিৎ ফিরে পেল। রুবাবা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, ‘কী ভাবছিলে তুমি? কতক্ষণ ধরে কথা বলছি।’ ‘ওহ্,sorry, কী বলছিলে?’ ‘সেটাও শুনতে পাওনি? বলছিলাম prawn curry এত ঝাল, আমার সর্দি লেগে যায়।’ ‘ও আচ্ছা।’ আরো দুই ঘণ্টা কিভাবে কাটল অয়নের মনে নেই। একটু পর পর চিন্তায় এশা চলে এলো। গল্পের মাঝখানে একটু পর পর অবিশ্বাসের স্বরে ‘সত্যি!’ বলে ওঠা এশার অভ্যাস ছিল। আরেকবার এই উৎসাহী বিড়ালছানাকে গল্প শোনানোর জন্য তার অস্থির লাগতে লাগল। রুবাবাকে নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে আসতে আসতে সে একটা সিগারেট ধরাল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। এত খালি খালি লাগে কেন? গত সাত মাসে সে এই অদ্ভুত শূন্যতায় ভুগছে। এত দিন মেয়েটার প্রবল ভালোবাসা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। হঠাৎ সেটা উধাও হয়ে যাওয়ায় তার জীবনে ছন্দঃপতন হয়েছে। রাত ১০টায় এশার বাসার সামনে দাঁড়াল অয়ন। গত তিন ঘণ্টা সে অন্ধকার রাস্তায় ইতস্তত হেঁটেছে। গেট দিয়ে ঢোকার সময় দারোয়ান কিছু বলল না। অনেক মানুষ যাওয়া-আসা করছে। কয়েকটা মেয়ে সেজেগুজে গ্যারাজের এক কোনায় খুব হাসাহাসি করছে। আলপনা আঁকা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল। এশাদের বাসায় দরজা হাট করে খোলা। সিঁড়ি থেকে ড্রয়িংরুম পর্যন্ত অসংখ্য জুতা ছড়ানো। অনেক মানুষ ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে, এর মাঝখানে এক কোনায় সোফায় টুপি পরা বাঁধানো খাতা কোলে বসে থাকা কাজিকে দেখে অয়নের বুক ধক করে উঠল। সে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। আজকে কি এশার বিয়ে? অয়নকে প্রথম লক্ষ করলেন এশার মা। সিঁড়িতে হেলান দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি প্রায় ছুটে বেরিয়ে এলেন। ‘তুমি অয়ন না?’ অয়ন সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। ‘কী করছ এখানে তুমি আজকে? প্লিজ, চলে যাও।’ অয়ন কোনো কথা বলল না। এশার মা গলা নামিয়ে অনেকটা মিনতির সুরে বললেন, ‘তোমার জন্য আমার মেয়েটা গত কয়েক মাসে অনেক কষ্ট পেয়েছে। প্লিজ, ওকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও। তুমি চলে যাও, বাবা।’ তাঁর পেছনে আরো অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে। এর মধ্যে অয়ন হঠাৎ এশাকে আসতে দেখল। টকটকে লাল শাড়ি পরে গা ভর্তি গয়না পরা এশাকে সে কোনো দিন কল্পনা করেনি আগে। মনে হলো রূপকথার দৈত্যের কাছে বন্দিনী কোনো রাজকন্যা এইমাত্র মুক্তি পেয়ে ছুটে এসেছে। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য এই মেয়ের কৌতূহলী চোখে বাঁধা পড়ে গেছে। আশপাশে আরো অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। তারা বিরক্ত হয়ে কানাকানি করছে। এশার বড় ভাই সৌরভ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত এই অস্থিরতার মধ্যে এশার শান্ত চেহারাটা দেখল অয়ন। এই মেয়েকে সে তিন বছর কিভাবে অবহেলায় ছুড়ে ফেলেছিল। ‘এশা, আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, কোনো দিন তোমাকে প্রাপ্য সম্মান দিইনি।’ এশা কিছু বলল না। অয়ন ব্যাকুল গলায় বলল, ‘আমি মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা মানুষ, যে তোমাকে পেয়েও হারিয়েছি। আমি তোমাকে হারাতে চাই না। প্লিজ, তুমি ফিরে এসো। এই বিয়েটা কোরো না।’ অয়ন আর কিছু বলার আগেই সৌরভ এসে প্রচণ্ড জোরে ওর পেটে একটা ঘুষি মেরে বসল। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই চুপ হয়ে গেছে। এর মধ্যেই অয়নকে এলোপাতাড়ি ঘুষি মারতে লাগল সৌরভ। এশার মা কোনোভাবেই ছেলেকে থামাতে পারছেন না। সৌরভ নিচে নিয়ে যেতে শুরু করল অয়নকে। ‘তোকে যদি আর এই এলাকায় দেখি, খুন করে ফেলব হারামজাদা।’ অয়ন দেখল, এশা ভেতরে চলে যাচ্ছে। সে চিত্কার করে বলল, ‘আমি তোমাকে এই বিয়ে করতে দেব না, এশা। তোমাকে নিয়ে যাব আমি। ওই ছেলেকে মেরে ফেলব।’ সৌরভ রেগে প্রচণ্ড জোরে অয়নের মুখে একটা ঘুষি মারল। রক্তে অয়নের শার্ট ভিজে গেল।\nরাতে কিভাবে বাসায় এসেছে অয়ন জানে না। মা-বাবা তাকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। সারা রাত জ্বরের ঘোরে অয়ন শুধু এশাকে দেখল। তার বিয়ে হয়ে গেছে। অয়নের মনে হলো, মানসিক কষ্টের কাছে শারীরিক কষ্ট কিছুই না।\nসকালে ঘুম ভাঙল অনেক দেরি করে। আয়নায় নিজের ব্যান্ডেজবাঁধা বিধ্বস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবল, এশা এখন অন্য কারো স্ত্রী। তাকে কি...? মেয়েটাকে ছাড়া সে বাঁচবে না। যেভাবেই হোক এশাকে সে ফিরিয়ে আনবেই। ও কোথায় আছে, সব ভালোভাবে জানতে হবে।\nজামা পাল্টে ড্রয়িংরুমে আসতেই সে পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত দৃশ্যের একটা দেখতে পেল। গোলাপি শাড়ি পরে গম্ভীর মুখে এশা সোফায় বসে চা খাচ্ছে। অয়ন কাঁপা গলায় বলল, ‘তু...তুমি এসেছ? সত্যি এসেছ! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’\n‘যে মারপিট করেছ, দেখতে এলাম হাড়গোড় অক্ষত আছে কি না।’\n‘তোমার কি বিয়ে হয়ে গেছে, এশা?’ সে করুণ গলায় জিজ্ঞেস করল।\n‘তোমার গুণ্ডামি দেখে আমার হবু শ্বশুর ভয়ে বিদায় হয়েছে। বিয়ে আর কী হবে।’\nঅয়ন আনন্দে প্রায় চিত্কার করে উঠল, ‘আমি তোমাকে আর কোনো দিন যেতে দেব না। কোনো দিন না, তুমি আমার।’\nতার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে এশা হেসে ফেলল, ‘গুণ্ডা ছেলের কাছে আমাকে কে বিয়ে দেবে?’\nঅয়ন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল এশাকে।\n \nলেখকঃ রিফাত রহমান পাপড়ি\nবিবিএ ফাইনাল সেমিস্টার\nইস্ট ওয়েস্ট ইউনির্ভাসিটি",
"img": "https://raw.githubusercontent.com/RIHeera/LoveStory/master/dwidha.jpg"
},
{
"name": "প্রেম ও আমি",
"description": "‘তাহলে আপনিই শিহাব?’ নিজের নাম শুনে মাথা তুলে তাকালাম। দেখি, সুন্দর মুখের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। হাতে সাদা রঙের মুঠোফোন। তাতে লেগে আছে শরীরে মাখানো পারফিউমের মিষ্টি একটা গন্ধ। গন্ধ শুঁকে চট করে পেয়ারাগাছের কথা মনে পড়ে গেল। ছোটবেলায় যখন বৃষ্টির দিনে পেয়ারাগাছে উঠে বসে থাকতাম, তখন এমনই একটা গন্ধ পেতাম নাকে। তাতে কত চেনা স্মৃতি মিশে আছে আমার! ছবিতে যেমন দেখেছিলাম, অবিকল সে রকম দেখতে। সেই চোখ, সেই ভ্রু, সেই নাক। আর সেই আঁকাবাঁকা মাড়ির দাঁতগুলো পর্যন্ত একই।\nবসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। কী বলব সেটা মনে মনে সাজানোর চেষ্টা করছি। মাথার ভেতর নদীর স্রোতের মতো হাজার হাজার শব্দ কোথা থেকে উড়ে এসে জানি উঁকি দিচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন দিয়ে কেউ একজন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কই আপনি?’ এর পরপরই এই ঘটনা। কোনটা রেখে কোনটা বলি। হঠাৎ তাল হারিয়ে ফেললাম। বললাম, ‘শ্রাবণী?’\n‘হুম্। চিনতে কষ্ট হচ্ছে আপনার? ছবির সঙ্গে কোনো ফারাক আছে নাকি? থাকলে বলেন।’ কেমন ফটফট করে বলে গেল সে। হালকা বাতাসে তার চুলগুলো মৃদু মৃদু উড়ছে। জিহ্বা দিয়ে সে পাতলা ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিল।\n‘না না, তা হবে কেন? বসো।’ পাশে জায়গা করে দিয়ে বসে পড়লাম। সেও বসল, তবে খানিকটা তফাতে। একটা নীল রঙের জামার সঙ্গে সাদা ওড়না পরেছে। মাথায় গোলাপি রঙের হেয়ারব্যান্ড। ফরসা মুখটাতে যেন দিনের সূর্য প্রতিফলিত হয়ে ফেরত যাচ্ছে দূরে, গালে এমন একটা ঝিলিক দেখতে পেলাম। মুগ্ধ নয়নে তার পানে একবার তাকিয়ে মাটিতে মুখ করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভালো আছ?’\nবুকে কেমন একটা দুরুদুরু ভয় কাজ করছিল, যার জন্য সহজ হতে পারছিলাম না। বহু মেয়ের সঙ্গে আগে তো প্রথম দেখাতেই অনেক কথা বলেছি। কই, তখন তো এমন হয়নি। আর এখন যার সঙ্গে আলাপের তিন মাস হয়ে গেছে, তেমন একজনের সঙ্গে কথা বলতে সংকোচবোধ হচ্ছে আমার। নিজের প্রতি ধিক্কার চলে এলো। পিঠ সোজা করে বসলাম। আচমকা সারা শরীরে পিঁপড়ার কামড়ের মতো জ্বালা শুরু হলো। জল না পেয়ে কয়েক দিনের তৃষ্ণার্ত চামড়াটা বিদ্রোহ করার পাঁয়তারা করেছে বোধ হয়। রৌদ্র-অ্যালার্জিটা এই জাগল বলে!\nপ্রশ্নটা শোনার পর উত্তর না দিয়ে শ্রাবণী বলল, ‘তার আগে মাথাটা এদিকে দেন আপনার, গুনে গুনে চারটা চুল ছিঁড়ি। তারপর যা বলার বলবেন।’\n‘চুল ছিঁড়বে মানে?’ চমকে উঠলাম। তা-ও আবার চারটা? মুখটা হাঁ হয়ে গেছে। বলে কী মেয়েটা? মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি! মনে মনে ভাবলাম।\nআমার এমন ভাব দেখেই কিনা কে জানে, শ্রাবণী চোখ দুটো গোল গোল করে বলল, ‘এত সহজেই ভুলে গেছেন। দুই দিন পর তো আমাকেও মনে থাকবে না।’ তারপর মুখটা গোমড়া করে চুপ মেরে গেল। কপট একটা অনুভূতি খেলা করছে তার পটলচেরা চোখ দুটোতে।\nঘটনার শুরু আজ থেকে তিন মাস আগে। দুপুরবেলার এক অবসরে বসে ফেসবুক চালাচ্ছিলাম কিছুদিন আগে কেনা পুরনো স্মার্টফোনে। হঠাৎ সাজেস্ট ফ্রেন্ডে একজোড়া চোখ দেখে থমকে গেলাম। এর আগে এমন চোখ যে দেখিনি, তা নয়। যাদের দেখেছি, তারা সবাই কারো না কারো সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।\nএই শঙ্কাটা মনে ছিল, তবু অজানা এক আগ্রহে তার আইডিতে উঁকি দিলাম। আমার বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী। এ বছর ভর্তি হয়েছে। কী সুন্দর মুখ তার! দেখে মনে হয়, এই বুঝি দুধ দিয়ে ধুয়ে দিয়েছে কেউ। এমন কাঁচা রং। ওর চোখ দুটো স্বাভাবিকের চেয়ে বড়। এত বড় চোখের মায়াতে পড়েই গেলাম শেষ পর্যন্ত। দোলাচলে দুলতে দুলতে কপালে যা আছে বলে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলাম। আর অপেক্ষা করতে লাগলাম।\nআনুমানিক দুই ঘণ্টা পর যখন আবার ফেসবুকে ঢুকলাম, তখন দেখলাম অ্যাকসেপ্ট করার নোটিফিকেশনটা চলে এসেছে। মনটা খুশিতে নেচে উঠল। আর দেরি না করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাকে মেসেজে নক করলাম। উত্তরও পেলাম কিছুক্ষণ পর। এমনি করেই আলাপচারিতা চলতে লাগল আমাদের। অনেক বিষয় নিয়েই কথা হচ্ছিল। প্রসঙ্গটা ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত বিষয়ের দিকে গড়িয়ে গেল। স্বীকার করতে দোষ নেই, তাতে পরোক্ষ ভূমিকাটা একতরফা আমারই ছিল। তখন দেখি ও মেসেজ দেখেও উত্তর দিতে খানিকটা সময় নিতে শুরু করল। ভাবলাম, এই বুঝি ফসকে গেল অল্পের জন্য। প্রবলভাবে হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে উঠলাম। একপর্যায়ে লজ্জার মাথা খেয়ে জানতে চাইলাম ওর বয়ফ্রেন্ডের পোস্টটা খালি আছে কি না। সে তো হেসেই খুন। বলল, এমনভাবে কেউ কখনো জিজ্ঞেস করেনি। তাই উত্তরও তার জানা নেই এবং প্রেম নিয়ে সে সিরিয়াস নয়। তবে হাবভাবে যা বুঝলাম তাতে মনের সবুজ বাতিটা না জ্বেলে পারল না। এবার তাকে বললাম, দরখাস্ত দিতে হলে হাতে লিখে দিতে হবে, না টাইপ করতে হবে? সে কোনো উত্তর করল না। সেদিনের মতো সে উধাও হয়ে গেল। কয়েক দিন কোনো খোঁজ ছিল না তার। গুম হয়ে যাওয়া বলতে যা বোঝায়, একেবারে আক্ষরিক অর্থে তা-ই। এর মাঝে আমি তাকে যে মেসেজ করিনি, তা নয়। উত্তর না পেয়েও বার্তার পর বার্তা দিয়ে গেছি এই ভেবে যে যদি কখনো সংকেত আসে। যদি একবার মুখ তুলে চায় ভাগ্যদেবতা। অবশেষে সেই দিনটির সাক্ষাৎ পেলাম। আকস্মিকভাবেই পেলাম। ঘড়ির কাঁটায় তিনটা বাজবে বাজবে করেও বাজছে না। এমন সময় একটা কল এলো ফোনে। শুয়ে ছিলাম, তাই চোখ বন্ধ করেই রিসিভ করি। তখন চিকন একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল—‘হ্যালো, শিহাব বলছেন?’\n‘হ্যাঁ, বলছি।’ গলার মধ্যে হঠাৎ নারীকণ্ঠ শোনার মতো একটা আশ্চর্য ভাব ফুটে উঠেছে।\n‘চিনতে পারছেন আমাকে?’ আরে, আজব তো! নিজে ফোন দিয়ে আমাকেই বলে কিনা তাকে চিনতে পারছি কিনা। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে নম্বরটা দেখে নিলাম। না, এ নম্বর আমার অপরিচিত। তবু স্বীকার করলাম না। চিন্তা করার জন্য কিছুটা সময় নিলাম। এই কয়েক দিনে কাকে কাকে নম্বর দিয়েছি মনে করার চেষ্টা করছি। তবু কিছু কিনারা করতে পারলাম না।\n‘চিনতে পারলেন না তো? জানতাম চিনবেন না।’ ওপাশ থেকে বলা হলো।\n‘কে? সন্ন্যাসী?’ কণ্ঠে সন্দেহ নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম।\nহাসছে কণ্ঠটা। ‘হুম্, আমি। চিনলেন কিভাবে?’\n‘বুঝতে হবে। চিন্তা করে বের করবেন।’\nঅত চিন্তা করার সময় নেই। তার পরের মিনিট পনেরো তুমুল আগ্রহে অনেক কথাই সে বলল। তার পরিবারের কথা, পছন্দের গানের কথা, ভালো লাগা রঙের গল্প—আরো কত কী! কথাগুলো শুনতে বেশ লাগছিল, তাই শুধু শ্রোতার ভূমিকা পালন করে গেছি আমি। শেষে বলল, ‘আমার এক আত্মীয় ফোন দিয়েছে, আপনাকে রাতে ফোন দেব কেমন।’ বলেই আকস্মিকভাবে ফোনটা রেখে দিল। খুব ভালো লাগছিল তখন। মনে হলো, যেন কত অমূল্য কিছু পেয়ে গেছি আমি। সত্যিই আমি পেয়েছিলামও। সেদিন থেকে টানা তিন মাস আমাদের কথা চলছিল। মান-অভিমানও কম হয়নি। আবার মিটেও গেছে। এর মধ্যে হৃদয়ের কত আবেগ দেওয়া-নেওয়া হয়ে গেছে একটু একটু করে। ধীরে ধীরে আরো গাঢ় হয়েছে আমাদের প্রেম। একদিন কথা না বললে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগত বুকটা। আজ সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে—বিশ্বাসই হতে চায় না সেটা।\n‘চুল ছিঁড়বে ঠিক আছে, তবে চারটাই কেন? তার কম বা বেশি কেন নয়?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি।\nসে মুখ তুলে তাকায়। তার দৃষ্টিতে কেমন একটা কালো পতাকা শূন্যতা নিয়ে মিছিলে নামল। বলল, ‘কারণ আছে। শুনবেনই তাহলে?’ তারপর বড় করে একটা দম নিল। দমের সঙ্গে সঙ্গে সাহসও নিল বুঝি কিছু।\n‘মনে আছে, ফোনে একদিন রাগী গলায় কথা বলেছিলেন আমার সঙ্গে। সেটা শুনে সারা রাত খুব কেঁদেছিলাম আমি। রাতের খাবারটাও খাইনি দুঃখে। কাঁদার জন্য একটা, আরেকটা খাবার না খেতে দেওয়ার জন্য।’\n‘মোটে তো দুটো হলো। আর বাকি দুটো? সেটার কারণও শুনি।’ কৌতুক মনে করে মুচকি মুচকি হাসছি। আমার চোখ থেকে তার চোখ নামিয়ে নিল সে। মাথা নিচু করে আছে।\n‘কী হলো, বলবেন না?’ আমি তাগাদা দিলাম।\nহঠাৎ দেখি, তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে গেলাম। কী করব ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে কি আনমনে তাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি?\nকিছুক্ষণ পর ও মুখ তুলল। কান্নায় চোখ জোড়া সিঁদুরের মতো লাল হয়ে গেছে। সত্য বলবে বলে হয়তো চোখে চোখ রাখে শ্রাবণী। তারপর নাক টেনে শক্ত গলায় বলল, ‘আমি শ্রাবণী নই। ওর যমজ বোন। আমার নাম লাবণী। আমাদের সব কিছু এক, কেবল কপালের কাছের এই দাগটা ছাড়া।’ ঘোরের মধ্যে সে আঙুল দিয়ে তার কপালের দাগ দেখাল। ‘কলেজে পড়ার সময় বাথরুমে পড়ে এটা হয়েছে আমার।’\n‘তাহলে শ্রাবণী কোথায়?’\n‘শ্রাবণী মারা গেছে।’ বলেই সে উঠে দাঁড়াল।\n‘মানে কী?’ আমিও উঠলাম। কথাটা শুনে মনে হলো, নিঃসঙ্গ কোনো বেনামি গ্রহের আকাশ ফুঁড়ে ধপ করে মাটিতে আছড়ে পড়লাম। হাড়গোড় সব চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে দলা পাকিয়ে গেছে। এটা কী শুনছি আমি! সৃষ্টিকর্তা কেন আমাকে এমন কষ্ট দিল। পাথরের মতো নিঃশব্দে অশ্রু ঝরতে লাগল দুই চোখ ভেঙে। ভেতরের সাগরটিতে বুঝি জোয়ার এসেছে খুব।\n‘আজ থেকে এক মাস আগে আত্মহত্যা করেছে ও। বিশ্বাস করুন, আপনাকে ও ঠকাতে চায়নি।’\n‘তবে আত্মহত্যা করল কেন?’ বাচ্চাদের মতো শব্দ করে ফুঁপিয়ে উঠলাম। বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে আমার। চন্দ্রাহতের মতো একের পর এক চাপড় মারছি বুকে।\nলাবণী বলল, ‘বেশ কয়েক দিন ধরেই ওর বিয়ের কথা চলছিল। হঠাৎ এক পাত্রপক্ষ এসে পছন্দ করে সেই রাতেই বিয়ে করে নিয়ে গেল ওকে। তার পরের দিন বিকেলে তার লাশ পাওয়া যায় ঘরের তীরের সঙ্গে লটকানো অবস্থায়। এই কয়েক দিন ওর হয়ে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলেছি। পারলে আমাকে মাফ করে দিয়েন।’\nতারপর সে আর কী বলেছে, সেটা কানে পৌঁছেনি। কোনো কিছু ভাবার মতো সময় ছিল না হাতে। টুকরো টুকরো করে গড়া এত দিনের স্বপ্নের পৃথিবীটা আমার চোখের অগোচরেই ভেঙে গেল। এমনই দুর্ভাগ্য আমার, টেরও পেলাম না। হঠাৎ পাগলের মতো এক ভোঁ-দৌড় দিলাম। কোথায় যাব, তা জানি না। শুধু এটুকু জানি, আমাকে দৌড়াতে হবে। দৌড়াতে হবে অনন্তকালের দৌড়।\n \nলেখকঃ নাজমুল ইসলাম\nআইআইটি, তৃতীয় বর্ষ\nজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়",
"img": "https://raw.githubusercontent.com/RIHeera/LoveStory/master/prem-o-ami.jpg"
},
{
"name": "মন আকাশের প্রজাপতি",
"description": "ক্লাস শেষে বের হওয়ার সময় হঠাৎ সজীব বলল, ‘আজ খাওয়াতেই হবে, হিমাদ্র।’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল হিমাদ্র—কেন? খাওয়াতেই হবে কেন?\n—কেন আবার, তুই ক্লাস পরীক্ষায় প্রথম হলি যে!\n—ক্লাস পরীক্ষায় প্রথম হওয়াটাও একটা কারণ হলো।\n—এত কথা বুঝি না, খাওয়াতে হবে, ব্যস।’ পাশে থাকা রাতুল জবাব দিল।\nপেছনে থাকা মুন্না ও আকরাম রাতুলের কথায় জোর দিল।\nসবার তোপের মুখে আজ আর শেষরক্ষা হলো না হিমাদ্রর। পকেটে অল্প কিছু টাকা পড়ে আছে, এ দিয়েই মাসটা চালাতে হবে। বন্ধুদের বিদায় দিয়ে পলাশীর পথ ধরে নীলক্ষেতের দিকে একা হাঁটছিল হিমাদ্র।\nনভেম্বরের শেষ দিক, উত্তরের বাতাস শীতের জানান দিচ্ছে। রোদের তাপ শরীরে খারাপ লাগছে না। তা ছাড়া দুপুরে এই পথে তেমন পথচারী না থাকায় হাঁটতে ভালোই লাগে। নীলক্ষেত পার হয়ে এলিফ্যান্ট রোডের মোড় ঘুরলেই হিমাদ্রর বাসা, তাই এ ক্ষেত্রে গাড়ির চেয়ে পা দুটিই বেশি ব্যবহার করে সে।\nমাস তিনেক হলো স্নাতকোত্তর কোর্সে এখানে (বুয়েট) ভর্তি হয়েছে হিমাদ্র। আতিকুল্লাহ স্যারের সহযোগিতায় প্রাপ্ত টিউশনির টাকায় খারাপ চলে না। কিন্তু এভাবে খরচ করা সহজ হয় না। নীলক্ষেত পার হয়ে ঢাবির রাস্তায় পড়েছে হিমাদ্র। বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল তার। আজকে যে টাকাটা খরচ হলো, তা দিয়ে বাড়িতে চার দিনের বাজার চলে যেত। না, এভাবে আর খরচ করা চলবে না। ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল হিমাদ্র। পেছনে গাড়ির প্রচণ্ড হর্নে ভাবনা ভাঙল, ফিরে তাকাল হিমাদ্র—দেখল একটা ‘টয়োটা এক্স-করলা’ পেছনে থেমেছে। হিমাদ্র ঘুরে তাকাতেই গাড়ি থেকে অরণী নেমে বলল, ‘কী ভাবছিলেন অত?’\nহিমাদ্র অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘আপনি? কোথাও যাচ্ছেন নাকি?’\n —হ্যাঁ, বাসায় যাচ্ছিলাম, কিন্তু এখন আর বাসায় যাব না।\n —মানে?\n —আপনাকে নিয়ে ঘুরতে যাব।\n —কোথায়? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল হিমাদ্র।\n —ভয় পাচ্ছেন? দুষ্টুমির ভঙ্গিতে বলল অরণী।\nখোঁচাটা হজম করল হিমাদ্র। গত দুইবারের আলাপে অরণী সম্পর্কে যা বুঝতে পেরেছে, তাতে অরণী তাকে এই মুহূর্তে ছেড়ে যাওয়ার পাত্রী নয়। কাজেই তর্কে না গিয়ে চুপচাপ গাড়িতে উঠল সে। কিন্তু শুধু দুবারের আলাপে তাকে এতটা বিশ্বাস কী করে করছে অরণী?\n—কি হলো, ভয় কাটেনি এখনো? নীরবতা ভাঙল অরণী। আবারও খোঁচাটা সহ্য করল হিমাদ্র ‘না, কিসের ভয়?’\n—তাহলে চুপ করে আছেন যে?\n—আপনার পড়াশোনা কেমন চলছে?\nকথাটা শুনে হাসল অরণী। ‘আমার কথা বাদ দেন। আপনার কথা বলেন। কোথায় থাকেন বলেন তো, দেখা নেই। ক্লাস আর বাসা ছাড়া আর কিছু মাথায় আসে না নাকি? ।\n—তা নয়, আমি তো আপনাকে ঠিকই দেখেছি।\n—দেখেছেন! কোথায়? আলাপ করেননি কেন?\n—আপনার সঙ্গে একটা ছেলে ছিল। একদিন বাইকে করে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন, আর একদিন ক্যাম্পাসের সামনে রাস্তার দেয়ালে বসেছিলেন। খুব সহজ গলায় বলল হিমাদ্র।\n—ও, ওর নাম সানি, আমার বন্ধু। একদিন আলাপ করিয়ে দেব। কথাটা বলে সামনের রাস্তা দেখায় অরণী। মন্থর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল সে।\n—শুধুই বন্ধু! সানির চোখ-মুখ কিন্তু অন্য কিছু বলছিল।\n—মানে?\n—সে বোধ হয় বন্ধুর চেয়ে একটু বেশিই ভাবছে।\nগাড়িটা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে পার্ক করল অরণী। ইঞ্জিনটা বন্ধ করে বলল, ‘ওটা তার ব্যর্থতা, চলেন।’ প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য হিমাদ্র জিজ্ঞাস করল, ‘এখানে কেন?’\nঅরণী কিছু না বলে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকল, পেছন পেছন হিমাদ্র। পেছনের দিকের টেবিলটায় বসল দুজন। পুরো রেস্টুরেন্ট মানুষে প্রায় পরিপূর্ণ। অরণী চেয়ারে হেলান দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আমাকে আপনি আপনি করেন কেন? আমি তো আপনার ছোট।’ কথাটা যেন কানেই গেল না হিমাদ্রর, তার মাথায় এখন অন্য ভয়—এখানকার খাবারের বিল যদি তার দিতে হয়, তাহলে তার পকেটে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।\n—বললেন না?\n—না, এমনি, তুমি বলার সাহস হচ্ছিল না।\n—অনুমতি দিলাম, এখন থেকে তুমি বলবেন। মুচকি হাসিতে কথাটা বলে বেয়ারাকে অর্ডারটা দিল অরণী।\n—এ রকম অনুমতি তাহলে আমার কাছ থেকেও নিতে হবে। আস্তে করে কথাটা বলল হিমাদ্র।\nএবার একটু জোরেই হাসল অরণী। হাসিটার জন্য অরণীর ওপর নজর পড়ল হিমাদ্রর। লম্বা-চওড়া বদনখানিতে ফুলহাতা থ্রি-পিস, মাথায় হিজাব দিয়ে চুলগুলো আটকানো, সুশ্রী মুখমণ্ডলের ঠোঁট দুটিতে হালকা রঙের লিপস্টিক লাগানো। বক্ষদেশ এমনভাবে কাপড়ে মোড়া যে সেদিকে নজর পড়ে না।\n—কী দেখছ অমন করে?\n—আজকাল সচরাচর ধনীর মেয়েদের এ রকম শালীন পোশাকে, সাবলীল চলাফেরায় দেখা যায় না।\n—ধন্যবাদ। তবে আমরা ওই রকম ধনী নয়ও কিন্তু।\nখাবার হিসেবে চিকেন বার্গার আর দুই গ্লাস জুস এসেছে। আজকাল ফাস্ট ফুড খাওয়ার একটা শ্রেণি তৈরি হয়েছে।\n—তোমার টিউশনি কেমন চলছে? প্রশ্ন করল অরণী।\n—আমি টিউশনি করি, তুমি জানো কিভাবে?\nজুসে চুমুক দিয়ে অরণী বলল, ‘আমি তোমার সম্পর্কে আরো অনেক কিছুই জানি, চলো উঠি।’ বলেই টেবিল ছাড়ল অরণী।\n \nদুই\nআজকাল প্রয়ই দেখা হয় হিমাদ্র আর অরণীর। এখানে-ওখানে চা-কফি খাওয়া, আড্ডা দেওয়া ছাড়াও জীবনের নানামুখী বাস্তবতা নিয়ে কথা হয় তাদের মধ্যে। সানিকে নিয়ে হিমাদ্রর মনে যে ভয় জন্মেছিল, সে রকম কিছু ঘটতে দেয়নি অরণী।\nআজ দুপুরটা মেঘলা, বৃষ্টি হতে পারে। ফুটপাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছিল দুজন। আকাশে মেঘ জমে থাকায় পরিবেশটা বেশ থমথমে, রাস্তায় লোকজন কম। হঠাৎ অরণী আস্তে করে বলল, ‘আমরা কি সারা জীবন এভাবে সুখে-দুঃখে একসঙ্গে হাঁটতে পারি না, হিমাদ্র?’\nকথাটা বুঝতে একটু সময় লাগল হিমাদ্রর, দুই পা সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াল—‘মানে?’\n—মানেটা তুমি জানো, হিমাদ্র। বলল অরণী।\n—কিন্তু তুমি জানো না। জোর দিয়ে বলল হিমাদ্র।\nমিনিটখানেক নীরব থাকার পর হিমাদ্র শান্তভাবে বলল, ‘দেখো অরণী, আমি জানি তুমি খুব ভালো মেয়ে, যে তোমাকে সঙ্গী হিসেবে পাবে তার জীবনে কোনো অপূর্ণতা থাকবে না। কিন্তু আমি তোমার যোগ্য নই।\n—যোগ্য-অযোগ্যর কথা নয়, তুমি ভালোবাস কি না?\n—এটা ছেলেখেলা নয়, অরণী। বাস্তবতাটা বোঝার চেষ্টা করো। তোমার পরিবার এটা কখনোই মেনে নেবে না, তা ছাড়া এই কঠিন সংসারজীবনে আমি তোমাকে সুখী করতে পারব না।\n—টাকা-পয়সার সুখের কথা ভাবছ তো, ও ভয় তুমি না-ই বা পেলে। অর্থ-প্রতিপত্তিতে সর্বদা সুখ হয় না, হিমাদ্র, মাঝেমধ্যে অপূর্ণতা ও অভাবের মধ্যেও সুখ খুঁজে পাওয়া যায়।\n—তুমি ইমোশনাল হয়ে পড়েছ, চলো বাড়ি যাও।\nহঠাৎ করে রাগ ধরে গেল অরণীর, ‘আমি মোটেই ইমোশনাল নই, আমি তোমার দিকটা জানতে চাই।\n—আমাকে ক্ষমা করো। অন্তর ফেটে যাচ্ছিল হিমাদ্রর, তবু কথাটা স্বাভাবিকভাবে বলল সে।\nতাত্ক্ষণিক আষাঢ়ে বৃষ্টির মতো অরণীর চোখ ভরে জল পড়তে লাগল। রাস্তাটা পার হয়ে অন্য ফুটপাত দিয়ে দ্রুত চলে গেল অরণী। পেছন পেছন যাওয়ার মনোবল পেল না হিমাদ্র, সে মাথাটা নামিয়ে রাস্তার পাশেই বসে পড়ল। এমন সময় বৈশাখী গর্জনে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এলো—সঙ্গে হিমাদ্ররও বুক ফেটে আর্তনাদ বের হতে লাগল।\n \nতিন\nদিন পনেরো গত হয়েছে, হিমাদ্র একবারের জন্যও দেখা পায়নি অরণীর। মনে মনে ক্যাম্পাস এলাকার বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেছে, কিন্তু দেখা মেলেনি। ফোনটাও বন্ধ দেখাচ্ছে। বাসায় যাওয়ারও সাহস হচ্ছে না। কিছুতেই যেন আজকাল ভালো লাগে না। উত্কণ্ঠা নিয়ে শহীদ মিনারের সিঁড়িতে বসে ভাবছিল কী করা যায়, এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল হিমাদ্রর।\n—হ্যালো, হিমাদ্র।\n—অরণী, তুমি কোথায়? কেমন আছ? সুস্থ আছ তো, তোমার ফোন বন্ধ কেন? কথাগুলো একসঙ্গে বলে গেল হিমাদ্র।\n—আমি ভালো আছি। তুমি কি আজ বিকেলে ফ্রি আছ? আমার সঙ্গে একটু দেখা করতে পারবে?\n—হ্যাঁ, কখন আসব বলো? হিমাদ্র উদ্বিগ্ন।\n—নির্ঝর কফি শপ, বিকেল ৫টা।\nফোনটা রাখার পর হিমাদ্রর নিজেকে অস্থির মনে হচ্ছিল। কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। এত দিন বাস্তবতা আর ভালোবাসার মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছে, তাতে একবারের জন্যও সে ভালোবাসাকে হারাতে পারেনি। কিন্তু অরণী এত দিন কী করেছে, সে কি তার কথায় ভিত্তি করে তাকে ভুলে গেছে, নাকি এখনো অরণী তাকে আগের মতো ভালোবাসে। নানা ভাবনা এসে ভিড় করছে মাথায়, সময় যেন কাটছেই না।\nনির্ঝর কফি শপের উত্তর কর্নারের টেবিলটায় নীল শাড়ি পরে বসেছিল অরণী। চোখের নিচে কালো একটা রেখা দেখা দিয়েছে, কিছুটা শুকিয়েও গেছে সে। অরণীকে এভাবে দেখে আজ প্রথম কী যেন হারানোর ভয় হলো হিমাদ্রর। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে বলল, ‘এ কী করেছ নিজের শরীরের!’\n—ও কিছু না, তুমি কেমন আছ?\n—না মরে বেঁচে আছি।\n—কেন?\n—কেন তা জানি না। তবে এ কয়টা দিন আমি ভালো ছিলাম না। কিন্তু তোমার এ অবস্থা কেন?\n—বড় আপুর সঙ্গে তোমার ব্যাপারে কথা হয়েছে। তুমি চাইলে আপু-আব্বুর সঙ্গে কথা বলবে, আর না চাইলে এটাই আমাদের শেষ দেখা। কথাগুলো খুব স্বাভাবিকভাবে বলছে অরণী, কিন্তু হিমাদ্র দেখল তার চোখ দুটি ছলছল করছে।\nঅন্যদিকে তাকিয়ে হিমাদ্র বলল, ‘মা বলতেন, কেউ যদি অনেক কষ্টে থেকেও তোমার কাছে সব গোপন করে পাছে তুমি কষ্ট পাবে ভেবে, তবে জেনে রেখো সে তোমাকে প্রকৃত ভালোবাসে। একই ঘটনা যদি অন্যের জন্য তোমার ক্ষেত্রে ঘটে, তবে তার জন্য তোমার ভালোবাসা সত্য। আমার মনে হয়, মায়ের কথাটা আজ দুজনের বেলায়ই সত্যি।’ অরণীর দিকে তাকাল হিমাদ্র।\n—ভালোবাসাকে আটকে বাস্তবতাকে জয়ী করার প্রচেষ্টা আমার ভুল ছিল। বাস্তবতা নিয়ে দিন কাটানো যায়, কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য চাই ভালোবাসা।\nমাথা নিচু করে বসে ছিল অরণী। হাতটা ধরে নিজের কাছে এনে হিমাদ্র বলল—\n‘তোমার দুঃখগুলি আমায় দাও\nকিনে নেব ভালোবাসা দিয়ে,\nআমার সুখগুলি তুমি নাও\nবিনিময়ে চাই না কিছুই ফিরিয়ে।’\n ...I Love You অরণী।\nঅরণী কোনো কথা বলতে পারল না, শুধু তার চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।\n \nলেখকঃ মুহাম্মদ আল-আরাফাত\nএমএসসি, রসায়ন বিভাগ\nনরসিংদী সরকারি কলেজ",
"img": "https://raw.githubusercontent.com/RIHeera/LoveStory/master/mon-akasher-projapoti.jpg"
},
{
"name": "ভালোবাসার মানুষ হয়ে ওঠার গল্প",
"description": "রানবীর : আচ্ছা, দাদা-দাদুকে আমাদের হার মানাতে হবে, বুঝেছ?\nমীম : কিভাবে হার মানাতে হবে? আর হার মানাতে হবে কেন?\nরানবীর : আমাদের দুজনের মধ্যে যে ভালোবাসা, সেটা যে দাদা-দাদুর চেয়ে অনেক গুণ বেশি, সেটা বোঝাতে হবে।\nমীম : কিভাবে বোঝাব?\nরানবীর : দাদা-দাদুর ছেলে-মেয়ে কয়জন?\nমীম : ১০ জন।\nরানবীর : আমাদের বাবু হবে ২০টা। তাহলে আমাদের মাঝের ভালোবাসা যে দাদা-দাদুর চেয়ে বেশি, সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে।\nমীম : আমাকে মেরে তোমার ভালোবাসা প্রমাণ করার বুদ্ধি, তাই না?\nরানবীর : কী বলো, তোমাকে মারার বুদ্ধি মানে?\nমীম : ২০টা বাচ্চা কি তোমার পেটে হবে নাকি আমার? আমি বাবা দুইটার বেশি বাবু নিতে পারব না।\nরানবীর : মাত্র দুইটা?\nমীম : হ্যাঁ গো, হ্যাঁ। ২০টা বাচ্চা দিয়ে তুমি কী করবা, যদি আমি বেঁচে না থাকি?\nরানবীর : তুমি বাঁচবে না কেন?\nমীম : ২০টা বাচ্চা হতে তো তোমার কিছু করা লাগবে না। তোমার দরকার খালি ২০টা রাত, ওদিকে আমার তো ২০টা বছর। বাব্বা, আমার চিন্তা করতেও ভয় লাগছে।\nরানবীর : দাদু পারলে তুমি পারবা না কেন?\nমীম : দাদু পারছে, কারণ দাদুদের সময় জন্ম নিয়ন্ত্রণের কিছু ছিল না। দাদার সঙ্গে মজার খেলা খেলতে খেলতে ১০ বার মা হয়েছে। সে আজকের দিন জন্মালে দুইটার বেশি বাবু নিতই না।\nরানবীর : আচ্ছা, আমরা জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য কী ব্যবহার করব?\nমীম : ছিঃ। এসব কথা বিয়ের পর বলবা, এখন এসব বললে একদম নাক ভেঙে দিব।\nরানবীর : তাই, আমার নাক ভেঙে দিলে আমি তোমার শরীরের ঘ্রাণ নিব কী করে?\nমীম : হয়েছে হয়েছে, আর ঢং করতে হবে না। সারা দিন বলে আমি ঢং করি, অথচ নিজে ঢং করার বেলায় কম যায় না। আমি এখন ঘুমাব।\nরানবীর : একা একা ঘুমাতে ইচ্ছা করে না আর।\nমীম : আবার শুরু করছ? চুপচাপ ঘুমাও। আমি রাখলাম।\nফোনটা সত্যি সত্যি রেখে দিল মীম। কিন্তু মীম জানে, রানবীরের ঘুম আসবে না। প্রতি রাতে মোবাইলে চুমু না দিলে এই বদ ছেলেটার ঘুম আসে না। তাই কিছুক্ষণ পর আবার কল দিল মীম। রিংটা না হতেই ওপাশ থেকে—\nরানবীর : হ্যালো মীম, বেবি, আই মিস ইউ।\nমীম : শুনো, আমি পুয়ারা করতে ফোন দেই নাই। তোমার ঘুমের ওষুধটা নাও, আর ঘুমাও। মুউউউয়া। বাই, গুড নাইট।\nফোন কেটে দিল মীম। এবার পাগলটা ঘুমাবে। সকালে দিব্যি বিছানায় পড়ে থাকবে, যতক্ষণ না মীম কল করে জাগাবে। সকালে ক্লাস আছে, এই ভাবতেই ঘুমে চোখ ছোট হয়ে এলো।\nওয়াশরুম থেকে এসেই লাইফ করে ঘুমিয়ে পড়ল। মোবাইলের লাইটটা জ্বলে উঠল। মীম বুঝতে পারছে পাগলটা গুড নাইট আর আই লাভ ইউ লিখে টেক্সট করেছে। এটা পাগলটার অভ্যাস। রিপ্লাই না দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল মীম।\nমীম আর রানবীর একে অন্যের কাজিন। তাদের বাবারা দুজন আপন ভাই। কিন্তু ভাই হলেও দুজনের মধ্যে সম্পর্ক খুবই খারাপ। অথচ মীম আর রানবীর কাউকে ছাড়া কেউ বাঁচতে পারবে না হয়তো। তাদের প্রেমটা শুরু হয় দুজনের বন্ধুত্ব থেকেই। পরিবারের দূরত্বটা কমাতেই মূলত তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করা শুরু হয়। একপর্যায়ে নিজেদের মধ্যে অনেক বোঝাপড়া হয়ে যায় এবং মনের অনেক মিল থেকেই তারা নিজেদের প্রতি দুর্বলতা অনুভব করে। একদিন মীমকে ফেসবুকেই অফার করে রানবীর। মীম প্রথমে রাজি হয়নি। কিন্তু রানবীরের রিজেক্ট হওয়া চেহারা মীম মানতে পারেনি। শেভ না করে করে মুখভর্তি দাড়ি, চুল না কেটে কেমন জানি এবড়োখেবড়ো চেহারা বানিয়ে ফেলেছে। ভার্সিটি পর্যন্ত মিস করা শুরু করে দিয়েছে। যেখানে দুই পরিবারের সম্পর্ক ভালো করার মিশনে নামছে মীম, সেখানে তাদের দুজনের সম্পর্কই খারাপ হয়ে যাচ্ছে দেখে মীম সাড়া দিল। এক দিনে অমানুষ থেকে মানুষ বানিয়ে, কাজিন থেকে বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে রানবীরকে নিজের করে নিল মীম।\nকিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, মীমের মনে ততই ভয় জন্মাচ্ছে; কেননা তার বিয়ের জন্য বাসায় কথাবার্তা চলছে। অন্যদিকে মীম আর রানবীর এখনো চুটিয়ে প্রেম করে যাচ্ছে, যেখানে বিয়ে নিয়ে তাদের কোনো প্ল্যান নেই। কিন্তু মীম আজকাল রানবীরকে বিয়ের ব্যাপারে দুই পরিবারকে রাজি করানোর জন্য খুব প্রেসার দিচ্ছে। রানবীর যেহেতু এখনো ছাত্র, তাই বিয়ে করার মতো সামর্থ্য তার নেই বলে সে কোনো উত্তর দিতে পারছে না। এ কারণে মীম অনেক রাগ হয়ে থাকে রানবীরের ওপর। কিন্তু রানবীর মীমকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না।\nঅতঃপর একদিন মীমকে দেখার জন্য বাসায় ছেলেপক্ষের লোক এলো। রানবীর মীমের হবু বরের সামনে সোফায় বসে বারবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখছে আর মীম আসার জন্য অপেক্ষা করছে। বাসার যেহেতু কেউই রানবীর-মীমের সম্পর্ক নিয়ে কিছু জানে না, তাই মীমকে দেখতে আসার অনুষ্ঠানে রানবীরের উপস্থিতি কারো চোখে কোনো সমস্যা না। কিন্তু রানবীর কেবল মীমকে একনজর দেখার জন্যই বেহায়ার মতো চলে আসছে। তা ছাড়া গত এক সপ্তাহে মীমকে দেখতে আসবে বলে মীম রাগ করে রানবীরের সামনে আসেনি। রানবীরও ‘কাপুরুষ’ শব্দটা মীমের কাছ থেকে ভালোভাবে নিতে পারেনি, তাই রানবীরও রাগ করে দেখা করেনি। কিন্তু আজ আর মন মানছে না।\nলাল শাড়ির পরিবর্তে হলুদ একটা শাড়ি পরে মীম সবার সামনে এসেছে। মীমকে বসতে দিয়ে নিজের আসন ছেড়ে হবু বরের পেছনে দেয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মীম এতক্ষণে বুঝতে পারছে, রানবীর তাকে দেখতে আসছে। মীমকে যতবারই মাথা তুলে মুখটা দেখাতে বলছে তার হবু শাশুড়ি, মীম ততবারই রানবীরকে দেখতে পাচ্ছে। আর বুঝতে পারছে রানবীরের চোখে জল জমে আছে, শুধু চোখের পাতাটা নামালেই জল নেমে আসবে গালে।\nমীমের গাল বেয়ে এবার চোখের পানি পড়ছে, এটা দেখে অনেকেই অবাক হলো। মীমের হবু শ্বশুর তো বলেই ফেলল— ‘মা, আজ তো আমরা কেবল দেখতে আসলাম, তুমি কাঁদছ কেন?’\nউত্তর না দিয়েই সবাইকে অবাক করে দিয়ে মীম বসা থেকে উঠে দাঁড়াল এবং হবু বরের পেছনে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো রানবীরের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। মীমের এমন কাণ্ড দেখে রানবীর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সবার দিকে একবার তাকিয়ে মীমের দিকে তাকাল। সবাই হিন্দি সিরিয়ালের মতো এক এক করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের দুজনের দিকে তাকাল। মীমও মনে হয় সবাই তাকানোর জন্য অপেক্ষা করছিল। সবাই যখন এক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকাল, ঠিক তখনই মীম রানবীরের ঘাড়ের পেছনে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে তার দুই ঠোঁট শক্ত করে কামড়ে ধরল।\nগত সপ্তাহেই দুজনের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হলো, আজ তারা দুজনে বিয়ের পিঁড়িতে। মীমকে দেখতে আসার ওই দিনে তার সেই সাহসিক কাজ শুধু তাদের দুজনের জীবনে সুখ বয়ে আনেনি, তাদের দুই পরিবারের কোন্দলেরও অবসান ঘটিয়েছে। অন্তত এই কারণে মীমের প্রতি দুই পরিবার কৃতজ্ঞ। আর রানবীরের কাছে তো মীম আজীবনই রানি আর নিজে মীমের কাছে কাপুরুষ। যদিও মীম এখন আর কাপুরুষ বলে না, কারণ ওই দিন রানবীর মীমের কাছে আসতে পারার সাহসই যে তাকে সাহসী করে তুলেছে, তা কেউ না জানলেও মীম নিজে তো জানে।\n\nলেখকঃ চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক\nএলএলএম\nনর্দান বিশ্ববিদ্যালয়",
"img": "https://raw.githubusercontent.com/RIHeera/LoveStory/master/valobasar-manush-hoye-othar-golpo.jpg"
},
{
"name": "ভালোবাসার পুনর্বাসন",
"description": "ক্যাম্পাসের তিন নম্বর গেটে মালিহাকে প্রথম দেখেছিল সামি। হাতে সিগারেট, চড়া গলায় এক লোককে কঠিনভাবে ধমকাচ্ছে।\nকৌতূহলবশত এগিয়ে গিয়ে ঘটনা জানা গেল, মালিহাকে সিগারেট টানতে দেখে লোকটা পাশ থেকে বলেছে, ‘মেয়েমানুষ এভাবে বিড়ি খায়? গজব পড়বে।’\nমালিহা রেগে গিয়ে লোকটাকে বকছে।\nদৃশ্যটা সামি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখল। ১০ মিনিট পর সবাই চলে গেলে সে হঠাৎ করে বুঝতে পারল, আরেকবার এই রাগান্বিতার বিরক্ত মুখ না দেখলে তার জীবন বৃথা।\nমালিহার খোঁজ নিতে গিয়ে সামি চমকে গেল। ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে লাফাঙ্গা গ্রুপের সঙ্গে মেয়েটার ওঠাবসা। দিনের বেশিরভাগ সময় এমনকি গভীর রাত পর্যন্ত ছেলেগুলোর সঙ্গে পড়ে থাকে মালিহা। এ রকম ছেলেদের সঙ্গে কথা বলবে, এটা সামি কোনো দিন ভাবতেও পারত না। অথচ শুধু মালিহার সঙ্গ পেতেই দলটিতে ভিড়ে গেল সে। তিনমাসের মধ্যে দলটিতে সামির একটি শক্ত জায়গাও হয়েছে। আড্ডায় না গেলে দল থেকে ফোন আসে। সামিও সময় দেয় ওদের।\nএকদিন সন্ধ্যার আড্ডার সবাই আগে চলে যাওয়ায় সামি হঠাৎ মালিহাকে একা পেয়ে গেল। ফটোগ্রাফারদের মতো এটাই তো ‘পারফেক্ট মোমেন্ট টু ক্যাচ’।\nমালিহা জানালার বাইরে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শান্ত দিঘির মতো মালিহার চোখের দিকে তাকিয়ে সামি বলল, ‘শোন, অনেক দিন ধরে তোকে একটা কথা বলতে চাই।’\nমালিহা এক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল। বলল, ‘জানি কী বলবি। গাঞ্জুট্টি মেয়ের প্রেমে পড়েছিস তাই না?’\nসামি থতমত খেয়ে বলল, ‘আমার চোখ দিয়ে নিজেকে দেখলে এভাবে বলতি না। তুই খুবই চমত্কার একটা মেয়ে। এত মেধাবী, এত মায়াবতী! এসব নেশা দিয়েও সেটা ঢেকে রাখতে পারিস না।’\nমালিহা গভীর চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভেতরটা কেন জানি সবসময় খালি খালি লাগে। সেই শূন্যতা কিছু দিয়ে পূরণ হয় না। শুধু নেশা করলেই একটু ফুরফুরা লাগে। আর বাসাটা এত ডিপ্রেসিং লাগে...।’\n—‘আমাকে একটা সুযোগ দে, তোকে দেখাবো জীবনে আনন্দে থাকার অনেক উপকরণ আছে।’\nতিন মাস পর এক রাতে মালিহা সামিকে ‘I wish I could see you’ টেক্সট করে ঘুমিয়ে পড়ল। আধাঘণ্টা যেতে না যেতে সামির রিংটোনে ঘুম ভেঙে গেল।\n‘মালিহা বারান্দায় আস’\nমালিহা আধা ঘুম চোখে হতভম্ব হয়ে দেখল সত্যি রাত ৩টায় সামি বাইকে তার বাসার সামনের রাস্তায়।\nবাসার স্লিপার পরেই স্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে এলো মালিহা। বাসার সবাই গভীর ঘুমে। সামি ভাবেনি, মালিহা সত্যি নিচে নেমে আসবে। সে অবাক হয়ে বলল,\n‘কী করলে এটা? ধরা খেলে কী অবস্থা হবে তোমার?’\n—৮টার আগে কেউ ঘুম থেকে উঠবে না। আর উঠলেই বা কী? এই রাতটা আমি হারাব না। চল। আজকে পালাব—বলেই মালিহা বাইকে চেপে বসে।\nসারা রাত দুজন বাইকে ঢাকা চষে বেড়ালো। ভোররাতে বাইক ছুটে চলল আরিচার দিকে। আরিচা ঘাটের একটা হোটেলে পরোটা-ডিমভাজি খেতে খেতে মালিহা বলল ‘তুই কি জানিস গত তিন মাসে উইড করা তো দূরে থাক, আমি একটা সিগারেটও খাইনি!’\nসামি ঝলমল মুখ করে মালিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।\n—আমার এখন আর খালি খালি লাগে না। তুই আমার জীবনের সব অপূর্ণতা দূর করে দিয়েছিস।’\nসামি মালিহার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকে।\nমালিহা বলতে থাকে ‘বেঁচে থাকা আগে ঝামেলা ভাবতাম, তুই আছিস বলে জীবনটা এখন অন্যরকম লাগছে।’\nসামির হাতটা বুকে চেপে ধরে মালিহা বলল, ‘No matter what happens, always hold onto our love.’\nদূপুরে বাড়িতে ফিরে মালিহা দেখে বাড়ির ভিতর সব আত্মীয় স্বজন জড়ো হয়েছে। তার দিকে চোখ যেতেই চিত্কার করে উঠলো কাজের মেয়ে ময়না। ‘আপারে পাওয়া গেছে’ বলে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেললো সে। সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মালিহাকে দেখছে।\nবাবাই প্রথম এগিয়ে এলেন। রাতে কোথায় ছিলি? এই বাড়ির মেয়ে হয়ে আজ সবার মান সম্মান পথের ধুলোয় মিলিয়ে দিলি!!!\nনিরুত্তর মালিহা সবার সামনেই নিজের রুমে চলে গেলো।\nকিন্তু সমস্ত ঘরটিকে লণ্ডভণ্ড করেছে কে!!!\nমা এসে জানালো তার ঘরে অনেকগুলো গাঁজাভর্তি সিগারেট আর কিছু ইয়াবা ট্যবলেট পাওয়া গেছে। এ নিয়ে সারাবাড়িতে তোলপাড় চলছে।\n—তুই কেন এমন করলি? মায়ের কথায় হাহাকার। তোর বাবা তোকে বাইরে যেতে নিষেধ করে গেছে।\nমালিহা বললো সে এসব ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু এও জানে এখন থেকে কেউ আর তাকে বিশ্বাস করবে না।\nসেদিন থেকে দিনগুলো আবার আগের মত বিষাদময় হয়ে উঠলো মলিহার। ঘরের সবাই তাকে সন্দেহের চোখে দেখছে। বাসার গেটে লেগেছে নতুন তালা আর নতুন দারোয়ান। বাইরে যাবার সব পথ রুদ্ধ।\n এক সপ্তাহ পর একদিন ঘুম থেকে উঠে মালিহা নিজেকে আবিষ্কার করে একটি অপরিচিত বিছানায়। তার পাশে একই রকম আরেকটা বিছানায় এক তরুণী পা তুলে বসে আছে। মালিহা উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগল। পাশের মেয়েটা বিরক্ত হয়ে বলল,\n‘এমন করছ কেন? লাভ নেই? এখান থেকে বের হতে পারবে না।’\n‘আমি কোথায়? এখানে কিভাবে এসেছি?’\nমেয়েটা শূন্য দৃষ্টিতে মালিহার দিকে তাকিয়ে থাকল। একটু থেমে বলল,\n‘এটা একটা মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্র।’\nমালিহা বিস্মিত হয়ে বলল,\n‘কে এখানে নিয়ে এসেছে আমাকে? কাল রাতেও আমার বিছানায় ঘুমাতে গিয়েছি।’\n‘আজকে সকালে তোমার বাবা রেখে গেছে তোমাকে।’\nমালিহার মাথার ভেতরটা ফাঁকা লাগছিল।\nপ্রায় জীবন্মৃতের মতো থেকে এক মাস কেটে গেছে এখানে। এখন মালিহার প্রতিদিনের ঘুম ভাঙে জীবনের প্রতি অসহ্য বিতৃষ্ণা নিয়ে। তার মনে হয়, এই কালো গহ্বর থেকে সে কোনো দিন মুক্তি পাবে না।\nএকদিন তার মা-বাবা দেখা করতে এলো। মা কাঁদছিল। মালিহা পাথরের মতো মুখ করে বলল,\n‘শুধু শুধু কাঁদার দরকার নেই। বাসায় গিয়ে ঘুমাও।’\nমা-বাবা চোখ বড় বড় করে তাকাল যেন ওদের সামনে একটা উন্মাদ বসে আছে।\nপাশের বিছানার নিশা নামের মেয়েটা এখন তার একমাত্র সঙ্গী। মেয়েটা অধিকাংশ সময় ফাঁকা চোখে তাকিয়ে থেকে তাও কেন জানি মালিহার মনে হয় মেয়েটা ওকে শুধু বুঝতে পারে।\nবুধবার মালিহার মেডিটেশন ক্লাস। রাত ১০টায় সবাই ছাড়া পেল। ক্লান্ত হয়ে সে দরজা ঠেলে ঢুকল। লাইট নেভানো ছিল। করিডর থেকে আসা আলোয় রুমের ভেতরে আবছায়ায় মালিহা তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্যটা দেখল। গলায় ওড়না পেঁচানো নিশার মৃতদেহটি ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে।\nচিত্কার দেওয়ার মতো ক্ষমতাও মালিহার নেই। মনে হলো অদৃশ্য কিছু তার মুখ চেপে রেখেছে, নিঃশ্বাস নিতে দিচ্ছে না।\nএবার মালিহা সত্যিই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেল। তাকে আর চেনা যায় না। শরীর ভেঙে গেছে। চোখ বসে গেছে। সেখানে প্রাণের কোনো ছায়া নেই। সে দিনরাত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থেকে নিশার ঝুলে থাকার ছবিটা মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে। তার মনে হয় যত দিন নিজে ফ্যানে ঝুলে না পড়বে, তত দিন এই ছবি মন থেকে যাবে না।\nমনে মনে ভাবে—আচ্ছা সামি কি জানে যে সে এখানে বন্দি? জানলে নিশ্চয়ই সে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে আসতো। সামির জন্য অপেক্ষা করার শক্তিও একসময় ফুরিয়ে আসে মালিহার। একদিন রাতে সে জীবনের চরম সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেললো। কি আশ্চর্য!! সে রাতেই তার চমত্কার ঘুম এলো। \nসে স্বপ্নে দেখল, অনেক ঝড়ের মধ্যে এক নৌকায় সে আর সামি বসে আছে। সামি শক্ত করে তার হাত ধরে বলল, ‘hold onto our love’।\nপরদিন খুব ভোরে খালি পায়ে পুর্নবাসন কেন্দ্রের ছাদে ওঠে মালিহা। ভাবছে যদি এখন সামিকে দেখতে পেত; জীবনের এই ইচ্ছেটাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এখন পর্যন্ত। মালিহার মনের ভেতরে ঝড় ও যুদ্ধ দুটোই। এক সময়ে হেরে যায় সে।\nসকাল ৭টার মধ্যেই পূর্নবাসন কেন্দ্রের সামনের রাস্তায় অনেক ভীড়। সবাই জটলা পাকিয়ে কি যেন একটা দেখছে। পাশেই পুলিশের গাড়ি। সামি যখন ভীড় ঠেলে সেই জটলার মাঝে এলো ততক্ষণে মালিহার রক্তমাখা নিথর দেহটি পূর্নবাসনের শেষ যাত্রার জন্য প্রস্তুত। পোষ্টমার্টেমের কাগজে সই নেওয়ার জন্য পুলিশের তরুণ অফিসারটি এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে।\nসামির চোখের সামনেই মালিহাকে একটি নোংরা মলিন চাদর ও চটে মুড়িয়ে একটি ভ্যানগাড়িতে তোলা হয়। গাড়ি ছুটতে থাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পথে।\n\nলেখকঃ সুহী আহমেদ সুসান\nবিবিএ, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি",
"img": "https://raw.githubusercontent.com/RIHeera/LoveStory/master/valobasar-punorbason.jpg"
},
{
"name": "শেষ চিঠি",
"description": "সকাল সকাল আম্মুর ডাকে ঘুম ভাঙল আমার। বাবা নাকি মস্ত বড় একটা রুই মাছ নিয়ে হাজির হয়েছেন বাসায়। এটা এখন দেখতে যেতে হবে।\n—রাসেল, আয় দেখে যা, তোর বাবা কত বড় মাছ এনেছে।\n—যাও, আসছি আমি।\nবিছানা থেকে উঠতে যাব, এই মুহূর্তে ইভার ফোন।\n—বিকেলে সেন্ট্রাল গার্ডেনের পাশে দেখা করো, তোমার দেয়া আংটিটা নিয়ে যেয়ো।\n—কেন?\n—বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।\n—সত্যি?\n—হুম্, খুশি হয়েছ তুমি?\n—তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, আর আমি খুশি হব?\n—কিছুই করার নাই, রাসেল।\nকিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না, ফোন রেখে দিল ইভা। আম্মু আবার ডাকতে এলো আমাকে, পেছন পেছন বাবাও। —কিরে, চল, মাছটা দেখবি।\nবাবার জোরাজুরিতে মাছ দেখতে যেতেই হলো। কিন্তু আমার কিছুই ভালো লাগছে না। বাবা মন খারাপ করলেন। আমি নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি।\nইভা আমাকে ২৯৯টা চিঠি লিখেছে। সব কয়টা নিয়ে বসেছি। রুমে আগুন জ্বালিয়ে আর একটা বেনসন সিগারেট জ্বালিয়ে একটার পর একটা চিঠি পুড়ছি আমি। একটায় ওর হাসিমাখা ছবি দেখে আর পুড়তে পারলাম না। এই মেয়েটিকে আমি গত ৫৯৬ দিন জীবনের সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি।\nআম্মু আমার রুমে এসে এসব পোড়ানো কাগজ দেখে একপ্রকার কান্না শুরু করে দিলেন। আমার হাতে ইভার পোড়া ছবি, স্নিগ্ধ ঠোঁটের আভা এখনো ঝলমল করছে। আম্মু বিষয়টি বুঝে কিছুটা সান্ত্বনা গোছের কথাবার্তা বললেন। কিন্তু মনে মনে ইভার ওপর আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল।\nআমি রাগ করে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। রাগটা তখনই ঝাড়তে হয়। ইভাকে ফোন দিলাম, সব রাগ উগরে দেব আজ।\n—হ্যাঁ, বলো রাসেল।\n—কী করো?\n—ও ফোন দিছিল। কথা বললাম।\n—ও-টা কে?\n—যার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।\n—ওই ব্যাটা তোমাকে ফোন দেবে কেন?\n—এটা কেমন কথা, রাসেল? ও তো ফোন দিতেই পারে।\n—না, বলবা বিয়ের পরে যেন ফোন দেয়।\n—পারব না। ফোন রাখো।\nমনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম, বিকেলে গিয়ে আংটিটা নিয়ে আসব, কোনো কথা বলব না।\nবিকেল ৪টা, ইভা লাল-সাদা একটা শাড়ি পরেছে। সাধারণত সে শাড়ি পরে না, আজ কেন পরল বুঝতে পারলাম না।\n—শাড়ি পরেছ কেন?\n—ও পছন্দ করে।\n—ও পছন্দ করে বলে পরেছ। আর আমি যে প্রতিদিন বলি, সেটা তো শোনো না।\n—তোমার কথা শুনব কেন?\n—ইভা ২৯৯টা চিঠি কি মিথ্যা?\n—চিঠি? এগুলো ছিল পাগলামি।\n—পাগলামি? তুমি এমন বলতে পারো না।\n—রাখো তো তোমার প্যাঁচাল, এই নাও। এখানে তোমার দেওয়া আংটিটা আছে, আর একটা চিঠি। এই আমার ৩০০তম চিঠি।\n—আবার চিঠি কেন?\n—৩০০ চিঠি পূর্ণ করলাম।\n—আচ্ছা আমি যাই, আমার ভালো লাগছে না।\n—যাবা? যাও।\nবাসায় এসে রুমের দরজা বন্ধ করে ইভার দেওয়া বাক্সটা খুললাম। একগাদা গোলাপের পাপড়িতে ভরা বাক্স। চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে বসলাম।\n“এই যে আমার বোকা বাবু, আমি বললাম আমার বিয়ে ঠিক, আর তুমি সেটাই বিশ্বাস করে নিলে। আমার ভালোবাসা কি এতই সস্তা? আমি ভালোবাসি তোমাকে, বুঝেছ বোকা বাবু? আমি একটা পরীক্ষা করলাম। আমার বিয়ের কথা শুনে তুমি যদি আমার চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেলো তবে মনে করব তুমি আমাকে ভালোবাসোনি। ভালোবাসার মানুষের স্মৃতি ধরে রাখাটা ভালোবাসার একটা অংশ। আমি আসছি চিঠিগুলো দেখতে।”\nআম্মু আমাকে ডাকছে।\n—রাসেল, কী করিস?\n—কিছু না।\n—ইভা আসছে, হাতে গোলাপ অনেকগুলো।\n—যাও, আমি আসছি।\nআমি ঘামছি। উঠে দাঁড়িয়ে আবার বসে পড়লাম, হাত-পা কেমন জানি অবশ হয়ে আসছে। ইভা চলে এলো আমার রুমে।\n—ইভা, তুমি?\n—হ্যাঁ আমি, আমার চিঠিগুলো কই?\nহাতে থাকা চিঠিটা ইভার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।\n—আরো বাকি ২৯৯, নিয়ে আসো।\nআমি অবাক বিস্ময়ে ইভার দিকে তাকিয়ে আছি। তবে কি আমি ইভাকে ভালোবাসিনি? ইভা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ‘রাসেল, এটা ভালোবাসা নয়, এটা আবেগ। ভালোবাসা হচ্ছে মনের ভেতর পুষে রাখা আকুতি। নীরবে ভালোবাসার মানুষটির সুখ কামনা করা। রাগের বশবর্তী হয়ে তুমি যেটা করলে, সেটা ভালোবাসা হতে পারে না।\nআমি কিছুই বলতে পারছি না, মনের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। আমি বুঝতে পারছি, আমি ইভাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি, যেটা শুধুই ভালোবাসা। এখানে আবেগের স্থান খুব অল্প। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইভা চলে যাচ্ছে, এই বুক খালি করে দিয়ে দূরে, অনেক দূরে।\n \nলেখকঃ রাকিব হাসান শাওন\nকৃষি অনুষদ, তৃতীয় বর্ষ\nশেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়",
"img": "https://raw.githubusercontent.com/RIHeera/LoveStory/master/shesh-chithi.jpg"
},
]